রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর \
দিনাজপুরের অবহেলিত ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি গ্রাম রুদ্রপুর। যেই গ্রামটির নাম এখন আন্তর্জাতিক অজ্ঞনে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। এই প্রত্যন্ত গ্রামে প্রকৃতি বান্ধব, ভিন্নধর্মী নির্মাণশৈলী দিয়ে নির্মিত ‘মেটি স্কুল’টি এখন বিশ্ব জোড়া নাম। স্কুলটির ভিন্নধর্মী স্থাপত্য শিল্পের জন্য পেয়েছে ২০০৭সালে আগা খান আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড। প্রত্যন্ত গ্রাম হলেও স্কুলটির কল্যাণে এখন দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে বিখ্যাত এই গ্রামটি।
এখন স্কুলটির নির্মাণশৈলী দেখার জন্য দিন দিন বাড়ছে দেশী-বিদেশী শিক্ষার্থীসহ পর্যটকের সংখ্যা। প্রতি মাসে সহ¯্রাধিক বিভিন্ন শ্রেনীপেশার মানুষ দেখার জন্য সেখানে যায়। প্রতিদিনই উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা থেকে দেশী-বিদেশী মানুষ ছাড়াও দুর-দুরান্ত থেকে শিক্ষা সফরে শিক্ষার্থীরা আসছেন।
শিক্ষার পাশাপাশি স্থাপত্যেও অনন্য এই মেটি স্কুল। দ্বিতল এ স্কুলের বৈশিষ্ট্য কক্ষে শিক্ষার্থীরা গরম কি শীতের অনুভূতি তীব্রভাবে অনুভব করে না। আলো-বাতাসের আগমনে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। ঘরগুলোও পরিবেশবান্ধব।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউপির রুদ্রপুর গ্রামের এ স্কুলটি গড়ে তুলে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘দীপশিখা’। এখন প্রতিদিনই গড়ে ৩০-৫০জন মানুষ দেখতে আসেন। এর মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষা সফরে এখানে আসেন।
২৫বছর আগেও এখানে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামই ছিল না। শিক্ষার্থীরা ৪/৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে অন্য কোনো গ্রামে লেখাপড়ার জন্য যেতো। অবহেলিত ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ইচ্ছা অনেকের থাকলেও আর্থিক সঙ্কট এবং উদ্যোগ অভাবে তা সফল হয়নি। তবে আর সেই রুদ্রপুর নেই। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার এ মেটি স্কুলই জ্বালিয়েছে সেই শিক্ষার আলো। প্রত্যন্ত গ্রামে লেখাপড়ার আলো ছড়িয়ে দিতে ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন দীপশিখার নির্বাহী পরিচালক ‘পৌল চারোয়া তিগ্যা’ ছোট্ট পরিসরে ‘মেটি স্কুল’ শুরু করেন। ছাত্র-ছাত্রীদের নাচ-গান-অভিনয়-চিত্রাঙ্কন, দলীয় আলোচনা ও কথোপকথন ভিত্তিক ইংরেজি শেখানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ শেখানো হচ্ছে।
‘মেটি’ একটি সংগঠনের নাম।যার পুরো নাম মডার্ন এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (মেটি)। কম খরচে এবং হাতের নাগালের উপকরন ব্যবহার করে মানুষের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে মেটি। আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদান, শিক্ষার প্রতি স্থায়ী ও ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি, যুক্তিযুক্ত চিন্তার বিকাশ ও দলীয়ভাবে শিক্ষাগ্রহণ এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মেটি স্কুলের যাত্রা। ১৯৯৯সালে স্কুলটির যাত্রা শুরু হলেও ২০০৫ সালে বিরল উপজেলার রুদ্রপুর গ্রামে মেটির স্থাপত্য মাটির স্কুলঘর নির্মাণ শুরু হয়, জার্মানীর ‘শান্তি’ দাতাসংস্থার অনুদানে। জার্মান ও অস্ট্রিয়ার ১০জন ছাত্র ও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্থানীয় ১৯জন শ্রমিক স্কুল নির্মাণে অবদান রাখেন।সহযোগিতা করেন দীপশিখা প্রকল্পের কর্মীরা।জার্মান আর্কিটেক্ট আন্না হেরিঙ্গার ও আইকে রোওয়ার্গ এর তত্ত¡াবধান করেন।
মেটি স্কুল নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি, খড়, বালু ও বাঁশ, দড়ি, খড়, কাঠ, টিন, রড, ইট ও সিমেন্ট। মাটি ও খড় মেশানো কাদা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এর দেয়াল। দেয়ালের ভিতের ওপর দেওয়া হয়েছে আর্দ্রতারোধক। দেয়ালের প্ল¬াস্টারে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি ও বালু। মেঝের প্ল¬াস্টারে পামওয়েল ও সাবানের পেস্ট ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণভাবে ওয়াটারপ্রæফ। মেটি স্কুলের ৯ ফিট উচ্চতার ওপরে প্রথম তলায় ছাদ হিসেবে বাঁশ বিছিয়ে ও বাঁশের চাটাই দিয়ে মাটির আবরণ দেওয়া হয়েছে। দোতলার ছাদে বাঁশের সাথে কাঠ দেওয়া হয়েছে। ওপরে বৃষ্টির পানির জন্য দেওয়া হয়েছে টিন। কোথাও ইট ব্যবহার করা না হলেও ঘরের ভীত হিসেবে ইট ব্যবহার করা হয়েছে।
চাইনবাবগঞ্জ থেকে দেখতে আসা মোঃ মনিরুল ইসলাম বললেন, বাস-মাটি-কাঠ দিয়ে তৈরী একটি স্কুলে যে এমন মনোরম পরিবেশ হতে পারে তা দেখে মুগ্ধ।যে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তাও খুব ভালো।
দেখতে আসা দর্শনার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বললেন, দ্বীপ শিখার মেটি স্কুলটি দিনাজপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারন করে। দিনাজপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাস-মাটি দিয়ে পরিবেশ বান্ধব যে সংস্কৃতি তৈরী করেছে। তা দেখার জন্য দুর দুরান্ত থেকে মানুষ আসে।
দ্বীপশিখা মেটি স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা মোছাঃ সাহিদা আক্তার জানান, ৯বছর ধরে কাজ করছি। নান্দনিক ও গ্রামীন পরিবেশে আধুনিক শিক্ষা দেওয়া হয়। যখন পড়তে ভালো লাগে তখন অনেক শিক্ষার্থীদের শুয়ে বসেও পড়ার সুযোগ রয়েছে।
দীপশিখার রুদ্রপুর প্রকল্প অফিসের এরিয়া ম্যানেজার ধনঞ্জয় দেবনাথ জানান, আমাদের এখানে বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে। একটি হচ্ছে মেটি স্কুল যার পুরো নাম মডার্ন এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (মেটি)। বর্তমানে ৪২১জন শিক্ষার্থী রয়েছে। পরিবেশকে সমুন্নত রেখে বাস-মাটি-কাঠ দিয়ে তৈরী এই মেটি স্কুলটি। জার্মান আর্কিটেক্ট আন্না হেরিঙ্গার এটি ডিজাইন করেন এবং এটি ২০০৭সালে মেটি স্কুলটি আগা খান অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। আরেকটি পরিবেশ বান্ধব বিল্ডিং আছে প্রতিবন্ধী বান্ধব।এটিও আন্তর্জাতিক ওভেল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। এখানে প্রতিবন্ধিদের সবরকম সেবা দেওয়া হয়। প্রতিবন্ধিরা শিক্ষা দেওয়া হয়। থেরাপি সেন্টার রয়েছে। নারীদের উন্নয়নে সেন্টার রয়েছে। এখানে ১৩জন নারী রয়েছেন তারা সমাজের ফেলে দেওয়া যেমন ছেড়া কাথাসহ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে দৃষ্টিনন্দন কাথাসহ বিভিন্ন জিনিস তৈরী করেন। আরেকটি কারিগরি শিক্ষার ভবন রয়েছে, যেখানে ২বছরের ইলেকট্রিক্যাল কোর্স চালু রয়েছে। ২বছর পর পর যেখানে দরিদ্র যুবকদের স্বাবলম্বী করতে ২৫জন করে নিয়ে এই কোর্স চালু রয়েছে। ১৯৮৪সালে এটি সমাজসেবার রেজিষ্ট্রেশনপ্রাপ্ত। যদিও এটি ১৯৭৭-৭৮সালে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত মানুষের জীবন মান উন্নয়নে যাত্রা শুরু করে।এটার স্বপ্নদ্রস্টা ছিলেন পোলসোরওয়ার্দী কেসার্ড। গুনগত মানসহ সব রকম সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত। রয়েছে বিশাল মাঠ, ক্যাম্পাস, রয়েছে কম্পিউটার সিস্টেম। এই প্রতিষ্ঠানটিকে দেখার জন্য প্রতিদিনই উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা থেকে দেশী-বিদেশী অনেক মানুষ দেখতে আসেন। এছাড়াও দেশের দুর দুরান্ত থেকেও প্রতিনিয়তই বাস-মাটি-কাঠ দিয়ে তৈরী নান্দনিক পরিবেশ বান্ধব এসব স্ট্রাকচারগুলো দেখতে আসেন।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে বিশ্বের ১৩টি স্থাপত্যের সাথে মেটি স্কুলকে আগা খান অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। পুরস্কার হিসেবে দীপশিখাকে ১৩,৭০০মার্কিন ডলার, আর্কিটেক্ট আন্না হেরিঙ্গারকে ১৬,৫০০মার্কিন ডলার ও আর্কিটেক্ট আইকে রোজওয়ার্গকে ৮,২০০ডলার দেওয়া হয়।