বোচাগঞ্জ (দিনাজপুর) প্রতিনিধি\ দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ উপজেলায় অপমৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। চলতি বছররের জানুয়ায়ী থেকে আগষ্ট পর্যন্ত আট মাসে উপজেলায় অন্তত শতাধিক মানুষ আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে কেউ মাদকাসক্ত হয়ে, কেউ অর্থকষ্টে আবার কয়েকজন দীর্ঘদিন রোগাক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকায় বিরক্তিবোধ থেকে নিজের জীবন শেষ করেছেন। এ বিষয়ে সচেতনার জন্য উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে দাবী করা হয়।
বোচাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্যমতে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৭৯ জনের অপমৃত্যু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ জনের তথ্য রয়েছে বোচাগঞ্জ থানার নথিতে, এই সংখ্যার কয়েজনের তথ্য উপজেলা স্বাস্থ্যপ্লেক্সেও খাতায়ও আছে। এর বাইরেও বেশকিছু ঘটনা ঘটছে। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ ও পরিবারের দেয়া তথ্য মিলিয়ে অন্তত ১০০ জনের আত্মহত্যার বিষয়ে জানা গেছে, তারা গত আট মাসে বিভিন্ন উপায়ে নিজের জীবন শেষ করেছেন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আত্মহত্যা করা অধিকাংশ মানুষের বয়স ১৭ থেকে ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে। দীর্ঘদিনের রোগভোগ, মানসিক অবসাদ, প্রেমে ব্যর্থতা অনলাইন জুয়া, অনলাইন গেমে আসক্তি, পরকীয়া ও অর্থনৈতিক কষ্টের কারণে তারা গলায় ফাঁস বা বিষপান করে নিজের জীবন শেষ করেছেন। তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে অবৈধ মাদকের নেশায় আসক্তি, ধর্মীয়জ্ঞানের অভাব,পারিবারিক অশান্তি, জীবন নিয়ে হতাশাজনিত কারণে।
পারিবারিক ও বোচাগঞ্জ থানার নথিভুক্ত থেকে জানা যায়,উপজেলার লোহাগাঁও গ্রামের নবম শ্রেণীর ছাত্র মোজাহারুল ইসলাম (১৫) ফ্রি ফায়ার গেমে আসক্ত ছিল। পরিবার থেকে নিষেধ করায় গত ১২ জুলাই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
৩০ মে মতিজাপুরের পইসান্জু রায় (৫০) কিডনি ও পেটের দীর্ঘদিনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। ৬ সেপ্টেম্বর মরিয়ম বেগম (৭২) শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমার যন্ত্রণায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ২৬ আগষ্ট রাতে উপজেলার বথ বাড়েয়া গ্রামে সোহেল রানার কন্যা শিমু আক্তার (১৪) নামে এক স্কুল ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
বোচাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান জাহিদ সরকার বলেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধে শুধুমাত্র আইনি পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। পরিবার ও সমাজকে সচেতন হতে হবে। আমরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি।
বোচাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মারুফ হাসান বলেন, অপমৃত্যু রোধে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। আমরা সেমিনার করছি এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন স্বাস্থ্য বিভাগ ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করে কাজ করছে।
বোচাগঞ্জ থানার এসআই শামীম আকতার অপমৃত্যু প্রতিরোধে নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার মতে, অপমৃত্যু বন্ধে সমাজের সর্বস্তরের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের কার্যকরী সমন্বিত উদ্যোগের বিশেষ প্রয়োজন।
তিনি আরোও বলেন এক্ষেত্রে পারিবারিক সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই। একই সাথে, যে সকল কারণে মানুষ আত্মহত্যার মতো জঘন্য কাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে যেমন: ডিপ্রেশন, পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক চাপ ও নেশায় আসক্তি, প্রেমে ব্যর্থতা, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অনলাইন আসক্তি প্রভৃতি প্রতিরোধে সমাজের সকলকে এগিয়ে আসার আহŸান জানান।
দিনাজপুরের একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, মানসিক চাপ, অবসাদ ও একাকিত্ব মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তাই শুধু আইন দিয়ে নয়, পারিবারিক ভালোবাসা, সামাজিক সহমর্মিতা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র একসাথে এগিয়ে এলে এই মৃত্যু মিছিল থামানো সম্ভব।
উপজেলার স্কুল রোড মসজিদের খতিব আব্দুল ওয়াহিদ শাহ বলেন, আত্মহত্যা মহাপাপ। প্রতিটি জীবন আল্লাহর অমুল্যদান। কেউই নিজের হাত দিয়ে জীবন শেষ করতে পাওে না।পারিবারিক সহমর্মিতা, সমাজের সমর্থন এবং ধৈর্যই মানুষকে মানসিক কষ্ট থেকে রক্ষা করতে পারে।
সেতাবগঞ্জ পৌর শহরের শ্রী শ্রী বাসুদেব মন্দিরের পুরোহীত পল্লব চের্টাজী জানান, আত্মহত্যা আমাদের সনাতন ধর্মে মহাপাপ। এটি কোনভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। তিনি আরো বলেন, এধরনের ঘটনার প্রতিকারে সমাজের সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে।