শিক্ষায় নিষ্ক্রিয়তার খেসারত ২০৩০ সাল নাগাদ জিডিপির ১৭%
কক্সবাজার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ইউনেস্কো ঢাকা, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)-এর সহযোগিতায় আজ কক্সবাজারে একটি উপ-জাতীয় কর্মশালার আয়োজন করে। কর্মশালার লক্ষ্য ছিল ‘দ্য প্রাইস অব ইনঅ্যাকশন’ রিপোর্ট ২০২৪’-এর ফলাফল প্রচারভিত্তিক আঞ্চলিক পর্যায়ের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে শিক্ষা বিনিয়োগ বৃদ্ধির গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা।
‘দ্য প্রাইস অব ইনঅ্যাকশন ২০২৪’ রিপোর্টটি ইউনেস্কো, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (OECD) এবং কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট যৌথভাবে প্রকাশ করেছে। প্রথমবারের মতো পরিচালিত বৈশ্বিক এ গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা শেখার বাইরে থাকলে কীভাবে অর্থনীতি ও সমাজের উপর বিরাট বোঝা চাপিয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বব্যাপী বর্তমানে ২৭২ মিলিয়ন শিশু স্কুলের বাইরে রয়েছে (১৩৯ মিলিয়ন ছেলে ও ১৩৩ মিলিয়ন মেয়ে), এবং ৫৭ শতাংশ শিশু এখনও মৌলিক দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। দক্ষতার এই ঘাটতির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ইতোমধ্যেই বছরে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তবে প্রতিটি শিশু যদি স্কুলে গিয়ে শিখতে পারত, তাহলে ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক জিডিপি বছরে ৬.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বৃদ্ধি পেত। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও দেশভিত্তিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং লিঙ্গ বৈষম্যহীন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এই বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কথা বিশেষভাবে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪৯% ছেলে এবং ৩৩% মেয়ে শিশু এখনো শিক্ষার বাইরে আছে। এছাড়াও বিদ্যালয়ে বা বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা শিশুদের মধ্যে ২১% গণিতে এবং বিজ্ঞানে মৌলিক দক্ষতার স্তরে পৌছায়নি। শিশুদের এই না শেখার ফলে, ২০৩০ সালে ব্যক্তিগত ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৬৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে, যা কিনা আনুমানিক জিডিপির ১৭%। মৌলিক দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থতা শুধু একজন শিশুর ভবিষ্যৎকেই অনিশ্চিত করে না, এর প্রভাব পড়ে পুরো সমাজ ও অর্থনীতির উপর। শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া ও দক্ষতা না অর্জনের ফলে দেশের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়, যার প্রভাব জিডিপিতেও পরে। এই ক্ষতি কেবল আর্থিক সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; অল্প বয়সে গর্ভধারণ, সহিংসতা ও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির মতো সামাজিক ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে। বিশেষত মেয়েশিশুরা এই ঝুঁকির মধ্যে বেশি পড়ে, কারণ জনসংখ্যার অনুপাতে তাদের হার তুলনামূলক বেশি।
কর্মশালার উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথি নায়েমের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. মোঃ জুলফিকার হায়দার বলেন, “ইউনেস্কো গবেষণা করেছে এবং আউটপুট দিয়েছে। এখন নায়েম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জেলা শিক্ষা অফিসারসহ আমাদের সবার দায়িত্ব হলো এই তথ্যগুলো অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আমরা যদি যার যার অবস্থান থেকে কাজ করি তবে দেশকে বদলে দিতে পারব।”
বিশেষ অতিথিবৃন্দের বক্তব্যে প্রফেসর মোঃ আমিরুল আনোয়ার চৌধুরী ও জনাব কাজী মফিজুর রহমান বলেন, শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার এবং জাতীয় উন্নয়নের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ অপরিহার্য। জিডিপি বৃদ্ধির জন্য মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ, পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মানসম্মত সময় নিশ্চিত করার ওপর তারা গুরুত্বারোপ করেন। একইসাথে কক্সবাজার একটি উপকূলীয় জেলা হিসেবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এই রিপোর্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও তারা তুলে ধরেন।
সভাপতির বক্তব্যে প্রফেসর মোঃ ফজলুল কাদের চৌধুরী, পরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম অঞ্চল, বলেন, “আমাদের এখনো কোনো স্থায়ী ও কার্যকর শিক্ষা নীতি নেই। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে সমন্বয় করে একটি বাস্তবমুখী ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন জরুরি। শুধুমাত্র সার্টিফিকেটকেন্দ্রিক শিক্ষার মাধ্যমে বাস্তব জীবনে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়।”
কর্মশালায় জেলা ও উপ-জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, এনজিও প্রতিনিধি ও যুবরা অংশ নেন। তারা গ্রুপ আলোচনার মাধ্যমে রিপোর্টের ফলাফল নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন কীভাবে তারা স্থানীয় পর্যায়ে স্কুলে ভর্তির হার বৃদ্ধি, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও ঝরে পড়া রোধে কাজ করবেন। নায়েমের প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ শামসুন আক্তার সিদ্দিকীর শুভেচ্ছা বক্তব্যে ‘দ্য প্রাইস অব ইনঅ্যাকশন রিপোর্ট ২০২৪’ এর প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন মো. রমজান আলী, ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার ফর এডুকেশন, ইউনেস্কো ঢাকা। এছাড়াও কর্মশালায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
রংপুরে আয়োজিত একই ধরনের একটি কর্মশালার ধারাবাহিকতায় কক্সবাজারে এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হলো। এসব উপ-জাতীয় কর্মশালা হচ্ছে “এডুকেশন ম্যাটারস: চ্যাম্পিয়নিং দ্য ট্রু ভ্যালু অব ইনভেস্টিং ইন এডুকেশন ফর এ স্ট্রংগার বাংলাদেশ” প্রকল্পের অংশ, যা NAEM বাস্তবায়ন করছে, পোর্টিকাস-এর সহায়তায় এবং ইউনেস্কো ঢাকার কারিগরি সহায়তায়।-প্রেস বিজ্ঞপ্তি