হাকিমপুর প্রতিনিধি\ জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান-পরবর্তী শিথিল অর্থনৈতিক কর্মকাÐের প্রভাব দেখা যাচ্ছে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর থেকে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এই সময়ে বন্দর থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৬২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। আদায় হয়েছে ৩১৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
কাস্টমসের দ্বিমুখী আচরণের কারণে রাজস্ব আহরণ কমেছে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে কাস্টমস বলছে, কম শুল্কযুক্ত পণ্য আমদানির ফলে রাজস্ব আহরণ কমেছে।
হিলি স্থলবন্দর শুল্ক স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) হিলি স্থলবন্দর থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে ৭৪০ কোটি টাকা। সেই অনুযায়ী অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৫ কোটি ৯ লাখ টাকা; বিপরীতে এসেছে ৪৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। আগস্ট মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা; বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৪৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা; বিপরীতে এসেছে ৫৫ কোটি আট লাখ টাকা। অক্টোবরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা; বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। নভেম্বরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা; বিপরীতে এসেছে ৪৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ডিসেম্বরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৯ কোটি ২১ লাখ টাকা; বিপরীতে এসেছে ৫৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
বন্দরের আমদানিকারক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘রাজস্ব ঘাটতির মূল কারণ হলো এই বন্দর দিয়ে যেসব পণ্য আমদানি হয়; যেমন চাল-ডাল, খৈল, ভুসি, ভুট্টা ও পেঁয়াজসহ অধিকাংশই শুল্কমুক্ত। সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় চাল। এতে যে শুল্ক ছিল সরকার সেটি প্রত্যাহার করেছে। এ কারণে রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। আরেকটি কারণ হলো আগে প্রচুর পরিমাণ ফল আমদানি হতো। কিন্তু সরকার ট্রাকের চাকা অনুযায়ী শুল্কায়নের প্রথা চালু রাখায় ফল আমদানি বন্ধ আছে। এটি যদি উন্মুক্ত করে দিতো অর্থাৎ যে যতটুকু পণ্য আমদানি করবে, সেই পরিমাণ পণ্যের শুল্ক দেবে তাহলে প্রচুর পরিমাণ ফল আমদানি হতো। সেইসঙ্গে রাজস্ব বাড়তো। পাশাপাশি অধিক শুল্কযুক্ত পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও এখানে বৈষম্য আছে। বেনাপোলে যে পণ্য সাড়ে তিন ডলারে শুল্কায়ন করা হচ্ছে, একই পণ্য হিলি বন্দরে পাঁচ ডলারে শুল্কায়ন করা হয়। ফলে আমদানিকারকরা এই বন্দর দিয়ে অধিক শুল্কযুক্ত পণ্য আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন। এসব জটিলতা কাটলে অধিক শুল্কযুক্ত পণ্য আমদানি বাড়বে, সেইসঙ্গে রাজস্বও বাড়বে।’
বন্দরের আরেক আমদানিকারক জুয়েল হোসেন বলেন, ‘এলসি খোলার সময় ডলারের এক রেট আবার পণ্য আমদানি করে সেটি বিক্রি করে ব্যাংকে বিল পরিশোধের সময় আরেক রেট ধরা হচ্ছে। এতে ডলারে তিন-চার টাকা করে বেশি দিতে হচ্ছে। ফলে পণ্য আমদানি করে লোকসান গুনতে হয় আমদানিকারকদের। আমি মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশের আমদানিকারক। যন্ত্রাংশের অনেক প্রকার রয়েছে। আমদানিকৃত পণ্যের ১০ ভাগ পরীক্ষার কথা থাকলেও এখানে সব কার্টন খুলে শতভাগ পরীক্ষা করে কাস্টমস। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছি আমরা। ফলে আমার মতো অনেকে এই বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। অপরদিকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এসব ঝামেলায় পড়তে হয় না।
হিলি স্থলবন্দরে রাজস্ব ঘাটতি ধারাবাহিকভাবে চলছে বলে জানালেন বন্দরের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহিনুর ইসলাম। তিনি বলেন, কেন জানি মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে বন্দরটিকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে কেউ। দিনে দিনে আমদানি কমে যাচ্ছে। বন্দরের রাস্তাঘাটগুলো ভাঙাচোরা, ব্যাংকগুলো চাহিদামতো এলসি খুলতে দেয় না। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো কাস্টমসের। সব বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে শুল্কায়ন হবে একই নিয়মে। হিলি বন্দরও একইভাবে চলবে কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিলেও বাস্তবায়ন হয় না। অধিক শুল্কযুক্ত কোনও পণ্য আমদানি হলে কাস্টমস নানাভাবে হয়রানি করে। এই এইচএস কোড চলবে না, এই শুল্ক চলবে না, বাড়তি শুল্ক দিতে হবে। একই পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বারবার কেমিক্যাল কিংবা বিএসটিআই টেস্টে পাঠানোর নামে হয়রানি করা হয়। এসব কারণে অনেকে পণ্য আমদানি করতে চায় না।
শাহিনুর ইসলাম আরও বলেন, আগে বন্দর দিয়ে প্রচুর পরিমাণ পাথর ও কয়লা আমদানি হলেও বর্তমানে বন্ধ আছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছি বুড়িমারী স্থলবন্দর ও সোনা মসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে এই দুটি পণ্য আমদানি করলে আরোপিত শুল্ক নিয়ে সেগুলো বন্দরের বাইরে রাখা হয়। কিন্তু হিলি দিয়ে এই দুটি পণ্য আমদানি করলে সেগুলো বন্দরের ভেতরে রাখে। যার কারণে বাড়তি খরচ গুনতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে একটি খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে বন্দরটি। বর্তমান সরকারকে এদিকে নজর দেওয়া দরকার।
হিলি কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফেরদৌস রহমান বলেন, ‘যেসব পণ্যের ওপরে রাজস্ব বেশি সেগুলো হিলি দিয়ে আমদানি হয় না। কারণ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এইচএস কোড ও শুল্ক নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করে। ফলে ওসব পণ্য বেনাপোল দিয়ে আমদানি হয়। ফলে সরকারের রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা সেটিতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আমার মনে হয় হিলি স্থল শুল্ক স্টেশনকে কাস্টমস হাউজ বানিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা শুল্ক আদায়ে দ্রæত সিদ্ধান্ত দিতে পারলে বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি যেমন বাড়বে তেমনি ব্যবসায় গতি আসবে। সেইসঙ্গে রাজস্ব আদায়ও বেড়ে যাবে।
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে হিলি স্থল শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা শফিউল ইসলাম বলেন, ‘অর্থবছরের গত ছয় মাসে হিলি বন্দরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা কম রাজস্ব এসেছে। এর কারণ হলো বর্তমান সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পণ্যের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিশেষ করে চাল, পেঁয়াজ, আলু ও মরিচের ওপর থেকে শুল্ক তুলে দেয়। বন্দর দিয়ে অধিক শুল্কযুক্ত পণ্য আমদানি হয় শুধুমাত্র জিরা ও কিসমিস। এই থেকে বেশি রাজস্ব আসে। আমদানি বেড়েছে। তবে শুল্ক তুলে দেওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। বর্তমানে যেভাবে আমদানি-রফতানি চলছে অর্থবছরের আগামী ছয় মাস এমন অবস্থা থাকলে আশা করছি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।