ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি\নদী মাত্রিক এই দেশে ‘আমরা মাছে ভাতে বাঙালি’ এই প্রবাদ এখন শুধু পাঠ্য বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এর চিত্র ভিন্ন। এক সময় গ্রাম বাংলার জলাশয়ে প্রচুর দেশী মাছ পাওয়া যেত। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে অনাবৃষ্টি-খরা, খাল-বিল ভরাট, মাত্রারিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, আবাসস্থল ধ্বংসসহ নানা কারণে আশঙ্কাজনকহারে কমেছে দেশীয় প্রজাতির মিঠা পানির মাছ । এসবের সাথে এবার যোগ হয়েছে ভয়ঙ্কর নিষদ্ধ চায়না দুয়ারী জাল।
বর্তমানে বর্ষা মৌসুম চলছে। নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী জাল দিয়ে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার ছোট যমুনা, তিলাই খাল ও ইছামতি নদীসহ বিভিন্ন খাল-বিল, ডোবা, জলাশয়সহ অবাধে দেশীয় প্রজাতির মাছ নিধনের মহোৎসব চলছে।
কিছু অসাধু মৎস্য শিকারী উপজেলার বুক চিরে প্রবাহিত হওয়া ছোট যমুনা নদীতে শিবনগর ইউনিয়নের পুরাতনবন্দর, দাদপুর, মালিপাড়া, ত্রিমোহনী, বেলতলীসহ খয়েরবাড়ী ও দৌলতপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় অবাধে চলছে চায়না দুয়ারী জালের ব্যবহার। এছাড়া বিভিন্ন নিচু জমি, ধানের জমি, খাল-বীল ও জলাশয়ে অবৈধ চায়না দুয়ারী জালের ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়ে বর্ষায় মাছের প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়া মা মাছসহ পোনা মাছ নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছে অনেকে। ফলে দেশীয় প্রজাতির মাছ হুমকির মুখে পড়েছে। এতে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা প্রচলিত পদ্ধতিতে টিকতে না পেরে পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন।
এ নিয়ে উপজেলা মৎস্য বিভাগের চরম উদাসিনতা লক্ষ্য করা গেছে। মাঠ পর্যায়ে তাদের কোন অভিযান বা নিষেধাজ্ঞা নেই বললেই চলে। এতে অসাধু মৎস্য শিকারীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
স্থানীয়রা বলেন, লোহার রিংয়ের সাথে মিহি সুতোয় তৈরি জালে আটকা পড়ে শুধু মাছই নয়, মারা পড়ছে শামুক-ঝিনুক, সাপ, কাঁকড়া-ব্যাঙ, কুচিয়াসহ অসংখ্য জলজ প্রাণি। এতে মিঠা পানির দেশীয় মাছ বিলুপ্তসহ জীববৈচিত্র চরম হুমকির মুখে পড়ছে।
অপর দিকে কোন রকম পরিশ্রম ছাড়াই এই জাল মাছের বিচরণ স্থলে শুধু বসিয়ে রাখলে পাওয়া যায় প্রচুর মাছ। ফলে ভিন্ন পেশার মানুষও নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী জাল দিয়ে মাছ শিকারে ঝুঁকে পড়েছেন।
নানা কারনে দেশীয় মাছের চরম আকাল চলছে। তার উপর এসব অসাধু মৎস্য শিকারীরা বেপরোয়াভাবে মরনফাঁদ নামক ওই জাল দিয়ে মাছের বংশ ধ্বংস করতে মেতে উঠেছে। যেন দেখার কেউ নেই! এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
সরেজমিনে উপজেলার পুরাতনবন্দর, দাদপুর, মালিপাড়া, ত্রিমোহনী, ¯øুইচগেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ছোট যমুনা নদীতে বসিয়ে রাখা হয়েছে জাল। নদীর দু কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ২০-৩০টি জাল দিনে রাতে বসানো হয়। ৫০ থেকে ৬০ মিটার দৈর্ঘের মাছের সর্বগ্রাসী চায়না দুয়ারী এই জাল পানির নিচে বসানো থাকে বলে উপর থেকে বোঝার উপায় থাকেনা। তবে কম পানিতে বসানো জাল দেখা যায় ও পুতে রাখা খুঁটির অবস্থান দেখে বোঝা যায়।
এসময় আরো দেখা গেছে, দেশীয় মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণি অনায়াসে জালের ঘোপের ভিতরে প্রবেশ করে আটকা পড়ছে। এ জালের ভিতরে একবার প্রবেশ করলে আর বের হতে পারেনা। আর মাছ সংগ্রহের জন্য জাল উপরে তুলে পরিচর্যা করা হয়। এসময় মাছ সংগ্রহের পর ডিম, পোনা মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণি শুকনো ডাঙ্গায় পড়ে মারা পড়ছে। ফলে বাস্তুসংস্থানের অভাবে প্রজাতি ধ্বংস হয়ে বিলুপ্তির পথে দেশী জাতের মাছ।
সরকারি ভাবে নিষিদ্ধ এই জালের অবাধ ব্যবহার দেখে স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগের চরম দায়িত্ব অবহেলায় অসাধু মৎস্য শিকারীরা বাধাহীনভাবে দেশীয় প্রজাতির মাছ নিধনে মত্ত হয়ে পড়েছে। তাই এদের লুলুপদৃষ্টি থেকে দেশীয় মাছ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তারা।
উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের মৎস্যজীবী কেরু মহন্ত বলেন, কিছু দিন আগেও নদীতে অনেক মাছ ছিল। মাছ ধরেই সংসার চলতো। চায়না দুয়ারী জালের কারণে নদীতে আর মাছ পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছি। এখন ঝালমুড়ি বিক্রি করে কোন রকমে সংসার চালাচ্ছি। আমার মত এই এলাকার অনেকে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে।
সচেতন মহল বলছে, বর্ষাকাল মাছের ভরা প্রজননকাল। অবাধে ম্যাজিক চায়না জাল দিয়ে মাছ ধরার কারণে নতুন পানিতে মা মাছ ডিম ছাড়তে পারছে না। এর ফলে প্রকৃতিকভাবে মাছের বংশ বৃদ্ধি ও উৎপাদন আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে। এখনই এ সর্বনাশী জালের ব্যবহার বন্ধ না করলে দেশীয় প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাবে। তাই এ মাছ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তারা।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে উপজেলা মৎস কর্মকর্তা রাশেদা আক্তার বলেন, নদী-নালা, খাল, বিলের মিঠা পানিতে ২৬০ প্রজাতির ও সাদু পানিতে ২৫৩ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এরমধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ হুমকির মুখে, যার মধ্যে ৯ প্রজাতির মাছ অতিবিপন্ন। ৩০ প্রজাতির মাছ বিপন্ন, ২৫ প্রজাতির মাছ শংঙ্কাগ্রস্থ। দেশী প্রজাতির মাছ বিপন্ন হওয়ার পিছনে পানি দুষণসহ নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী জালের ব্যবহারও এর অন্যতম কারন।
মৎস্য কর্মকর্তা আরও বলেন, চায়না দুয়ারী জালের ব্যবহার বন্ধে উপজেলা মৎস্য অফিস কাজ করে যাচ্ছে। কোথাও নজরে আসলে তাৎক্ষনাৎ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে তা ধ্বংস করা হচ্ছে। তবে অধিকাংশ জাল রাতে বসানো হয় বলে ধরা সম্ভব হয় না।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসাহাক আলী জানান, মা ও পোনা মাছ রক্ষায় মৎস্য অফিসের সাথে সমন্বয় করে নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী জালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে আইগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।