ষ্টাফ রির্পোটর
নানা সমস্যায় জর্জরিত ৫০ শয্যা বিশিষ্ট ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ৩১ শর্য্যার জনবল দিয়েই চলছে ৫০ শর্য্যার চিকিৎসা কার্যক্রম। রং চং করে হাসপাতাল ভবন চাকচিক্য করা হলেও এক যুগেরও অধিক সময় ধরে অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে এক্স-রে মেশিন। নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন ও ডেন্টাল চেয়ার। মাঝে মাঝেই নষ্ট হয়ে পড়ে সরকারি এ্যাম্বুলেন্সটি। জোড়াতালি দিয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম। প্রতিদিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে হাসপাতালে আগত শত-শত রোগী যথাযথ চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকায় বাধ্য হয়েই তাদের অধিক টাকা খরচ করে প্রাইভেট ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে গিয়ে এক্স-রে সহ বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হচ্ছে। এছাড়াও জরুরী বিভাগে টাকা ছাড়া কাটা-ছেড়া রোগীর সেবা পাওয়া যায় না এমন অভিযোগ অনেকের। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, সমস্যা সমাধানে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকার জানানো হলেও এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা হয়নি।
জানা যায়, উপজেলার প্রায় ৪ লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্য সেবার ভরসাস্থল পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ২০১০ সালে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩১ শর্য্যা থেকে ৫০ শর্য্যায় উন্নিত করা হয়। কিন্তু ৫০ শর্য্যার জনবল পদায়ন করা হয়নি। ৩১ শর্য্যার জনবল দিয়েই দীর্ঘদিন ধরে চলছে ৫০ শর্য্যার কার্যক্রম। ২০০৯ সাল থেকে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালের এক্স-রে মেশিনটি। এটি চালু করার জন্য কর্তৃপক্ষ বহুবার উর্দ্ধতন দপ্তরে পত্র প্রেরণ করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা হয়নি। সড়ক দূর্ঘটনা ও মারামারির ঘটনায় গুরুত্বর জখম এবং বর্তমান করোনা সময়ে করোনা উপসর্গের রোগীদের জন্য এক্স-রে করা জরুরী হলেও এক্সরে মেশিন নষ্ট থাকায় হাসপাতাল থেকে এসব রোগী ঐ সেবা পাচ্ছেন না। সড়ক দূর্ঘটনা ও মারামারির ঘটনায় গুরুত্বর জখম রোগীদের পীরগঞ্জের বিভিন্ন ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে এক্স-রে করা হলেও করোনা উপসর্গের কোন রোগীরই বুকের এক্স-রে করছেন না তারা। এতে চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে করোনা উপসর্গ থাকা রোগীদের। এসব রোগী সরকারি হাসপাতাল এবং প্রাইভেট ডায়াগনষ্টিক সেন্টারেও সেবা পাচ্ছেন না। দীর্ঘ এক বছর ধরে অকেজো রয়েছে ইসিজি ও আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন। এতে বিশেষ করে গর্ভবতী, হার্ট ও পেটের সমস্যায় আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালে এ সেবা পাচ্ছে না। অধিক টাকা খরচ করে হাসপাতালে বাইরে থেকে তাদের এক্স-রে, ইসিজি এবং আলট্রাসনোগ্রাম করাতে হচ্ছে। ডেন্টাল চিকিৎসক না থাকায় নষ্ট হয়ে পড়ে আছে ডেন্টাল চেয়ার। দুই বছর আগে এ হাসপাতালে ডেন্টাল চিকিৎসক পোস্টিং দেওয়া হয়। ততদিনে ডেন্টারের চেয়ার সহ অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহার না হওয়ার কারণে নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে ডেন্টাল চিকিৎসক থাকলেও চেয়ার এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি সচল না থাকায় সঠিক চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না দাঁতের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আগত রোগীরা। প্রায় চলাচলের অনুপযোগী সরকারি এ্যাম্বুলেন্সটি। সপ্তাহের বেশিরভাগ সময়ই অচল হয়ে পড়ে থাকে এটি। স্থানীয় মেকারের মাধ্যমে ঠিকঠাক করে জোড়াতালি দিয়ে মাঝে মাঝে চালানো হয়। এ এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে এ হাসপাতাল থেকে জরুরী প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার জন্য দিনাজপুর ও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ডকৃত রোগীরা এ এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সঠিক সময়ে ও স্বল্প খরচে যেতে ভরসা পারছেন না। বাইরের ভাড়া করা মাইক্রোবাসে করে তাদের দিনাজপুর ও রংপুরে যেতে হচ্ছে। অবশ এর চিকিৎসক অভাবে সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধ আছে প্রায় ৫ বছর ধরে। হাসপাতালে সিজারের ব্যবস্থা না থাকায় আগত অধিক ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভবতীদের বাইরের কোন হাসপাতালে অথবা ক্লিনিকে রেফার্ড করেন সংশ্লিষ্টরা। এতে রোগীর স্বজনদের অধিক অর্থ খরচ হয়। রোগীদের বিভিন্ন ক্লিনিক বা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে নিতে এক ডজনেরও অধিক দালাল সক্রিয় রয়েছে হাসপাতাল চত্ত¡রে। রোগী এলেই পিছে পিছে ছুটেন তারা। পরীক্ষা নিরীক্ষা, এক্সরে সহ সকল প্রকার সুযোগ কম খরচে দেওয়ার কথা বলে হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগীতা রয়েছে এসব দালাল চক্রের মধ্যে। তারা রোগী ও তার স্বজনদের এক প্রকার টানা হেচড়া করেই ক্লিনিক কিংবা ডায়ানগষ্টিক সেন্টারে নিয়ে যান। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর স্থানীয় প্রতিনিধিরা রোগীর ব্যবস্থা পত্রের ছবি তোলা নিয়েও ব্যস্ত থাকেন। এতে অনেকের ব্যক্তিগত সমস্যার কথাও জেনে যান তারা। এ নিয়ে বিব্রত হন অনেক রোগী। তবে রক্ত ও মলমূত্র পরীক্ষার কার্যক্রম স্বাভাবিক আছে। কিন্তু অনেকেই বিষয়টি জানেন না। এ কারণে হাসপাতালে রক্ত ও মলমূত্রের পরীক্ষাও হয় সীমিত। হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন, ডেন্টাল চেয়ার, ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন ও এ্যাম্বুলেন্স অকেজো থাকার কারণে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। এদিকে সড়ক দূর্ঘটনায় আহত কিংবা কাটা-ছেড়া করা প্রয়োজন এমন রোগী জরুরী বিভাগে আসলে টাকা ছাড়া সেবা পান না বলে অভিযোগ অনেকের। ভ‚ক্তভোগীদের অভিযোগ টাকা না দিলে জরুরী বিভাগের দায়িত্বে থাকা ওয়ার্ড বয়রা এসব রোগীর শরীরে হাত দিতে চান না। ৫০/১০০ টাকা দিলে সেবা দেন ঠিকই।
পীরগঞ্জ পাঠচক্রের সভাপতি মোশারফ হোসেন সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, পীরগঞ্জ হাসপাতালে কোন চিকিৎসা সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। সব ধরণের যন্ত্রপাতি নষ্ট। করোনার ভয়ে ডাক্তাররাও ঠিকমত হাসপাতালে আসছেন না। আসলেও রোগীদের দূর থেকে দু’এক কথা জিজ্ঞেস করে ঢালাও ভাবে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট লিখে দিচ্ছেন। অথচ এইসব চিকিৎসকই প্রাইভেট চেম্বারে দেদারসে রোগী দেখছেন। এগুলো কি দেখার কেউ নাই?
শান্তিবাগ মহল্লার গৌতম দাস জানান, এ সময়ে ঘরে ঘরে জ্বর, সর্দি, কাশির প্রকোপ দেখা দিয়েছে। হাসপাতালে গেলে করোনার ভয়ে কেউ এগিয়ে আসছেন না। এ উপজেলায় চিকিৎসা কার্যক্রম ভেঙ্গে পড়েছে।
গুয়াগাঁও এলাকার সাথী আক্তার জানান, হাসপাতালের রোগ নির্ণয়ের মেশিনগুলো নষ্ট থাকায় বাইরে থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। ডাক্তারদের দেখিয়ে দেওয়া নিদির্ষ্ট ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে পরীক্ষা নিরীক্ষা না করলে তারা রিপোর্ট দেখেন না।
হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ আব্দুল জব্বার বলেন, অচল এক্স-রে মেশিন সহ অন্যান্য যন্ত্রপাতির বিষয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে বহুবার জানানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা হয়নি। সেবাদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনা কালিন সময়ে হাসপাতালের চিকিৎসকরা সাধ্যমত চিকিৎসা সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন। আমাদের পক্ষ থেকে কোন প্রকার গাফিলাতি করা হচ্ছে না। হাসপাতাল চত্ত¡রে কোন দালালকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয় না।