রবিবার , ৪ জুন ২০২৩ | ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জাতীয় চা দিবস আজ সবুজ পাতার দাম না পেয়ে চা বাগান কেটে ফেলছেন চাষিরা \ উত্তরের চা শিল্প কি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে?

প্রতিবেদক
ঠাকুরাগাঁও সংবাদ
জুন ৪, ২০২৩ ১১:২৫ পূর্বাহ্ণ

পঞ্চগড় \জাতীয় চা দিবস আজ। এরই মধ্যে পঞ্চগড়সহ উত্তরের কয়েকটি জেলা নিয় গঠিত সমতলের চা অঞ্চল নতুন করে চা উৎপাদনে রেকর্ড গড়লেও আশা ভঙ্গ হচ্ছে চা চাষিদের। ক্রমাগতভাবে সবুজ চা পাতার দাম কমে যাওয়ায় দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে চা বাগান মালিকদের। কমিটি নির্ধারিত দরের চেয়ে অনেক কম দামে চা কারখানায় সবুজ পাতা দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এর ওপর খাড়ার ওপর মরার ঘা হিসেবে যোগ হয়েছে প্রায় অর্ধেক পরিমান পাতা কর্তন। এতে করে লাভ তো দুরের কথা; উৎপাদন খরচও উঠাতে পারছেন না তারা। ইতোমধ্যে অনেক চা বাগান মালিক তাদের চা বাগান কেটে অন্য আবাদ করার পরিকল্পনা করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে উত্তরের সম্ভাবনায় চা শিল্প চিনি শিল্পের অবস্থায় পৌছবে বলে আশংকা চা চাষিদের।
জাতীয় চা দিবসে চা চাষিদের অস্তিত্ব রক্ষায় কাঁচা চা পাতার দাম সর্বনি¤œ ৪০ টাকার নির্ধারণ, পঞ্চগড়ে সরকারিভাবে চা কারখানা প্রতিষ্ঠা করাসহ ৯ দফা দাবি আদায়ে পঞ্চগড়ে মানববন্ধন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে চা বাগান মালিক সমিতি। আজ রোববার সকালে সাড়ে ৯টা থেকে জেলা শহরের চৌরঙ্গী মোড় থেকে সরকারি অডিটোরিয়ামের সামনে পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়কের ধারে ঘন্টাব্যাপী মানববন্ধনে অংশ নেবেন পঞ্চগড়ের কয়েক হাজার চা বাগান মালিক।
২০০০ সালে পঞ্চগড়ে চা চাষ শুরু হওয়ার পর থেকেই বাড়তে থাকে চা আবাদি জমির পরিমান। এরপর থেকে আশপাশের ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুরে ছড়িয়ে পড়ে সমতলের চা চাষ। দেশজ চা উৎপাদনে দেখা দেয় নতুন সম্ভাবনা। প্রতি বছরই চা উৎপাদনে রেকর্ড করতে থাকে এই চা অঞ্চল। গত বছর সমতলের এই চা অঞ্চল থেকে রেকর্ড এক কোটি ৭৭ লাখ ৬০ হাজার কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে। যা জাতীয় চা উৎপাদনের ১৯ শতাংশ। চা বোর্ডে হিসেবে এই অঞ্চলে প্রায় ১৩ হাজার একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু পঞ্চগড়েই রয়েছে ১০ হাজার একরেরও বেশি চা বাগান। বড় বাগানের পাশাপাশি এখানে ক্ষুদ্র চা চাষির সংখ্যাও ১০ হাজারের বেশি।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে চা কারখানা কম থাকলেও চা বাগান মালিকরা প্রতিকেজি সবুজ পাতা বিক্রয় করতে পারতো ২৫ টাকা থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত। সার, কীটনাশকসহ মজুরি বৃদ্ধির কারণে এবং প্রচন্ড খড়ায় সেচ দেয়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলেও সবুজ পাতার দাম নি¤œমূখী। সময়ের সাথে সাথে সবুজ পাতার দাম বৃদ্ধির কথা থাকলেও এখন সেই সবুজ পাতা বিক্রয় হচ্ছে সর্বনি¤œ দরে। চা বাগান মালিকদের দাবি চা কারখানাগুলো কাঁচা চা পাতা মূল্য নির্ধারণ কমিটির নির্ধারিত ১৮ টাকা কেজি দরে পাতা না নিয়ে বর্তমানে ১৩ থেকে ১৪ টাকা দরে কাঁচা চা পাতা কিনছে। এখানেই শেষ নয়, বড় আকারের চা পাতা আনার অজুহাতে শতকরা ৩০-৪০ শতাংশ কেটে রাখছেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ একশত কেজি কাঁচা চা পাতা এনে চা বাগান মালিকরা ছয়শ থেকে সাতশ কেজির দাম পাচ্ছেন। এতে করে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার দাম পড়ে ১০ টাকারও কম। অথচ এক কেজি কাঁচা চা পাতা উত্তোলনসহ উৎপাদন খরচ পড়ে ১৫-১৬ টাকা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন চা বাগান মালিকরা। চা কারখানা বাড়ার সাথে সাথে প্রতিযোগিতা করে কাঁচা চা পাতার মূল্য বাড়ার কথা থাকলেও সিন্ডিকেট করে সব কারখানা একই দামে পাতা কিনছেন-দাবি চা বাগান মালিকদের। এ অবস্থায় অনেক চা বাগান মালিক কেটে ফেলছেন চা গাছ। তবে আগের মতই খোড়া যুক্তি দেখাচ্ছেন কারখানা মালিকরা। তারা বলছেন কাঁচা চা পাতা মূল্য নির্ধারণ কমিটি বাগান থেকে চার পাতার কচি চা আনার নির্দেশনা দিলেও বাগান মালিকরা তার চেয়েও দ্বিগুন বা তারও বেশি কান্ডসহ ভেজা পাতা আনায় চায়ের মান খারাপ হচ্ছে। নিলাম মার্কেটে তারা সর্বনি¤œ দরে চা পাতা বিক্রয় করার নির্ধারিত দামে তারা পাতা কিনতে পারছেন না।
তেঁতুলিয়ার চা চাষি ইউসুফ আলী বলেন, প্রতিবছর বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। আগের চেয়ে বেশি করে কীটনাশক স্প্রে করতে হচ্ছে। সারের দামও অনেক বেড়ে গেছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় চা বাগানে সেচ দিতে হচ্ছে। এক কেজি কাঁচা চা পাতা তুলতে শ্রমিকদের দিতে হয় ৩ টাকা। ধার-দেনা আর এনজিওর ঋণ নিয়ে চা বাগানে বিনিয়োগ করেছি। সার-কীটনাশকের দোকানে অনেক টাকা বাকি। আর পারছি না। আর কত লোকসান গুনবো। তাই বাধ্য হয়ে চা বাগান কেটে ফেলছি। এই জমিতে অন্য আবাদ করলেও বছরে অনেক টাকা পাবো।
বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন চা চাষিদের হতাশার কথা স্বীকার করে বলেন, ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসককে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। তিনি সভা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি আরও বলেন, চায়ের মান বাড়াতে চা বাগান মালিক ও কারখানা মালিকদের উদ্যোগ নিতে হবে। চা চাষিরা যেন ছোট আকারের পাতা কারখানায় আনে সে ব্যাপারে আমরা তাদের উদ্ধুদ্ধ করছি। কারখানা মালিকদের বলেছি ছোট পাতা আনলে নির্ধারিত দামেই যেন তারা পাতা কিনেন। চায়ের মান বাড়াতে পারলে নিলাম মার্কেটে ভাল দাম পেলে কারখানা মালিকরও বেশি দামে পাতা কিনতে পারবে। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়ও বিষয়টি নিয়ে অবগত রয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি পঞ্চগড়ে এসে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলবেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক ও কাঁচা চা পাতা মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভাপতি জহুরুল হক বলেন, সভা ডেকে চা বাগান মালিকদের সমস্যা নিরসনের চেষ্টা করা হবে। তিনি আরও বলেন, পঞ্চগড়ে চা নিলাম মার্কেট চালু হলে এর সুফল চা চাষিরা পাবে।

সর্বশেষ - ঠাকুরগাঁও