তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) প্রতিনিধি:
হাট বাজার থেকে প্রতিদিন বালটিতে বালটিতে ময়লা তুলে নিয়ে যেতে দেখা যায় উচ্চ শিক্ষিত এক তরুণকে। প্রথমত দেখে সবাই অবাক হলেও এ তরুণের ময়লা নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে রয়েছে দুষণমুক্ত পরিবেশ গড়ার বার্তা। হাটবাজার ঘুরে ঘুরে মাছ কাটার উচ্ছিটাংশ, নাড়ি-ভুড়ি, মুরগী কাটা ময়লা বালটিতে বালটিতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে সে। আবার সাইকেলে সেট করা বইয়ের ঝুড়ি ও ব্যাগে গাছের চারা নিয়ে ঘুরছেন গ্রামের পর গ্রাম। পলান সরকারের মতো তুলে দিচ্ছেন বই, ধরিত্রী রক্ষায় নিজের টাকায় গাছের চারা কিনে উপহার দিচ্ছেন বিভিন্নজনকে।
এই তরুণ আর কেউ নয়; বিনে পয়সায় গাছের চারা বিলানো ও ঘুরে ঘুরে বই পড়ানো পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার পরিবেশ বন্ধু ও শিক্ষাকর্মী মাহমুদুল ইসলাম মামুন। সীমান্তঘেষা আজিজনগর গ্রামের আজহারুল ইসলাম ও মাহমুদা বেগমের দ্বিতীয় পুত্র মাহমুদুল ইসলাম মামুন। বিনে পয়সায় পড়ানো ও গাছ বিতরণে মামুনের রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি।
প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় বাজারের মাছ দোকান থেকে ময়লা বালটিতে ভরে যাচ্ছিলেন এ তরুণ। ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েও কেন এই কাজ করছেন মামুন ! মামুন রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি করেছেন। উচ্চ ডিগ্রি নিয়েও নেননি কোন চাকরি। সামাজিক সচেতনতা ও পরিবেশ উন্নয়নে হয়ে উঠেছেন পরিবেশ বন্ধু, পলান সরকারের মতো আরেক পলান সরকার।
বাজার থেকে ময়লা নেয়ার বিষয়টি বাজারের এক মাছ ব্যবসায়ী উমর আলীর কাছে গেলে তিনি জানান, মাছের নাড়ি-ভুড়ি ফেলার জায়গা ছিলো না আমাদের। মাছ কাটার পর এসব ময়লা নদীতে ফেলতাম। চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। মামুন এসে বললেন, ময়লা যত্রতত্র ফেলায় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। নদী দূষণ হচ্ছে। উপায় না দেখে মামুন আংকেল নিজেই এগুলো নিয়ে যায়। কয়েক বছর ধরে স্বেচ্ছায় করে যাচ্ছে সে।
একই কথা বলেন মুরগী কাটা রতন। তিনি বলেন, আমাদের মুরগী জবাই করার পর চামড়া, নাড়ী-ভুড়িগুলো নিয়ে নদীতে ফেলতাম। কিন্তু মামুন ভাই পরিবেশ দূষণের কথা জানান। আমরা কি করবো, কোথায় ফেলবো এসব। তাই মামুন ভাই প্রতিদিন এসে এগুলো নিয়ে তার নিজের ও প্রতিবেশি গরীব মানুষদের হাঁস-মুরগীর খাবার হিসেবে দেন, কখনো পথের কুকুর, বিড়ালকে খাওয়ান। জৈব সারও বানান।
এভাবেই কয়েক বছর ধরে হাটবাজারের মাছ ব্যবসায়ী, মুরগী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত দোকানদারদের মাঝে মামুন পরিবেশ সচেতনতা তৈরি করছেন। পরিবেশ রক্ষা ও শিক্ষায় নানাবিধ কাজ করেও বাজারের ময়লা আবর্জনা বয়ে নিয়ে রিসাইকল করছেন। আশেপাশের বিশ গ্রামের মামুন লক্ষাধিক গাছ বিতরণ করেছেন। প্রতিদিন বইও পড়িয়ে চলছেন। এছাড়া গ্রামে গ্রামে আসার বসান এই অদম্য তরুণ। সমাজের উল্টো ¯্রােতের এত কাজ করে ক্লান্ত হন না কখনো।
বাজার থেকে ময়লা-আবর্জনা নেয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে মাহমুদুল ইসলাম মামুন জানায়, শৈশব থেকে আমি গাছ লাগাচ্ছি, পড়াচ্ছি ও পরিবেশ দূষণ সচেতনতা তৈরির কাজ করছি। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখছি হু হু করে উষ্ণায়ন বাড়ছে। দূর্যোগ আসছে। এসব মানুষেরই কারণে। ময়লা আবর্জনা পচে মিথেন তৈরি হয়। সে মিথেন গ্যাস উষ্ণায়নে হাওয়া দেয়, গাছ লাগানোর পাশাপাশি উষ্ণায়ন কমাতে নানাভাবে ভাবতে হবে। আমি এই বার্তাটাও দিয়ে যাচ্ছি। আমরা যে খাদ্য অপচয় করি, উচ্ছিটাংশ এসবও পঁচে মিথেন গ্যাস হয়ে উষ্ণায়নে হাওয়া দেয়। আমি কাজ করে বিজ্ঞানের যুক্তিতে সবাইকে বুঝাই।
রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে মাস্টার্স করা এই তরুণের কাজে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেবে বলে প্রশাসন ও আঞ্চলিক পরিবেশ বিভাগ তিনবার পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র পাঠালেও কেউ আজও কোন খোঁজ নেয়নি বলে জানা যায়।
মামুনের মা মাহমুদা বেগম। তিনি ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছেন মানুষ ও পরিবেশের কল্যাণের জন্য। সব সময় মামুনের কাজকে এগিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আমার ছেলেটা শৈশব থেকেই দেশ সেবা করছে নানাভাবে। আমারও দেখতে ইচ্ছে করে রাষ্ট্র ওর জন্য কী করলো।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রান্তিক জনপদে সামাজিক সচেতনতা, পরিবেশ দূষণ রোধ ও গাছের চারা বিলিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের লড়াইয়ে মামুনের ক্লান্তিহীন এ কাজ সত্যিই অসাধারণ। বিশেষ করে পরিবেশ ও নদী দূষণ রোধ করতে বাজার থেকে ময়লা-আবর্জনা রিসাইকল করা উদ্যোগটি অনন্য উদাহরণ। আমরা প্রশাসনিকভাবে তাকে এসব কাজে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করছি।
