তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) প্রতিনিধি
মাদকের ভয়ংকর স্পট হয়ে উঠেছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার ভজনপুর ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রাম। মাদকের নেশায় বুঁদ এখানকার তরুণ-সমাজ। এতে করে গ্রামের পরিবারগুলোতে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। কিভাবে মাদকের ভয়াল নেশা সন্তানদের দূরে রাখবেন, এমনটি দু:শ্চিন্তায় পড়েছেন বহু পরিবার।
উত্তরের সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের ত্রি-সীমান্ত ঘেষা তেঁতুলিয়া উপজেলা। তিনদিক দিয়ে সীমান্ত থাকায় মাদকের নিরাপদ রুট এসব সীমান্তপথগুলো। বিভিন্ন সীমান্ত রুট ব্যবহার করে মাদককারবারীরা আনছেন সর্বনাশা মাদক। অন্যদিকে এ গ্রামের পাশেই বাজার। এ বাজারটিতে রয়েছে একটি ফিলিং স্টেশন ও ট্রাক টার্মিনাল। টার্মিনালে প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক গ্যারেজ থাকায় ট্রাকের চালক ও হেল্পারদের চাহিদার কারনেই গ্রামটিতে গড়ে উঠেছে মাদক ও জুয়ার আখড়া।
স্থানীয়রা জানান, মাদকের সয়লাবে ভরে গেছে গ্রামটি। মাদক, জুয়া, দেহব্যবসা চলছে সমতালে। সন্ধ্যা নামলেই চলে আনাগোনা। বসে জুয়ার আসর। আড়ালে মাদক সেবন আর দেহ ব্যবসা। মাদক ব্যবসায়ী, মাদক সেবনকারী, জুয়া কারবারীদের বিনোদনের স্পটও গ্রামটি। বিভিন্ন জায়গা থেকে অপরিচিত লোকজন এসে ঢুকে পড়ে একেক ঘরে। শুরু হয় রাতভর মাদক আর জুয়ার কালো অধ্যায়। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করছে মাসুদ, বাদশা, সোহেল, শফিকুল ও সায়দার আলী নামের কয়েকজন যুবক। তাদের কারণে হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক।
মাদকের সয়লাবের কারণে আসক্ত হয়ে পড়ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও। অনেক শিক্ষার্থীই নিয়মিত স্কুল-কলেজ যাচ্ছে না। প্রায় শুণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে শিক্ষা অনুরাগির সংখ্যা। গ্রামের প্রায় ঘরে ঘরে মিলছে নেশাগ্রস্ত সন্তান। এসব নিয়ে চরম অসহায় অবস্থায় পড়েছেন পরিবারগুলো।
ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ রমজান আলী জানান, তার ২০ বছর বয়সী ছোট ছেলে আবুল কালাম মাদকের নেশায় পড়ে মানসিক রোগীর মতো হয়ে পড়েছ। মাদক সেবনে টাকা না পেলে মারধর করে। এলাকার মানুষজনের জিনিসপত্র চুরি করে। এই বৃদ্ধ বয়েসে গ্রামের মানুষদের সামনে লজ্জায় মুখ দেখাতে পাচ্ছেন না।
মাদকাসক্ত ছেলেকে একই সমস্যা পড়েছেন একই গ্রামের নুর ইসলাম। তিনি জানান, তার ছেলেও মাদকাসক্ত যুবকদের সাথে মিশে মাদকের নেশায় পড়েছে। মাদকের টাকা না পেলে ছেলে পকেট কিংবা আলমারি থেকে টাকা চুরি করে মাদক সেবন করে। এমনকি মাদক সেবনের টাকা না পেয়ে মায়ের গহনা পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে সে। সন্তানের এমন কার্যকলাপের কারণে এলাকায় তিনি মুখ দেখাতে পারছেন না বলে জানান। এমন পরিবার এ গ্রামের আরও অনেক।
নুরজ্জামান হক নামের এক ব্যবসায়ী জানান, এই গ্রামে প্রায় ৭০ ভাগ মাদকের সয়লাব। এর পিছনে স্থানীয় প্রভাবশালীরা জড়িত। যার কারণে নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এই পরিস্থিতে ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে ছেলে-মেয়েদের জন্য কোন ভাল ঘর থেকে বিবাহের সমন্ধ আসছে না। গ্রামের এই দুরাবস্থার নিরসন চান তিনি।
এ গ্রামের শিক্ষার্থীরা জানায়, এখানে প্রকাশ্যে মদ, ফেনসিডিল, ইয়াবারমত মাদক বিক্রি হচ্ছে। আমাদের অনেক সহপাঠী মাদকের নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মাদক ও জুয়ার টাকা জোগার করতে তারা চুরি করছে বিভিন্ন কিছু। এই অসামাজিক অবস্থার পরিত্রাণ চান শিক্ষার্থীরা।
জাহাঙ্গীর আলম নামের এক পাথর ব্যবসায়ী বলেন, আমি সব সময় মাদকের বিরুদ্ধে। মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মাদককারবারিদের রোষানলে পড়েছি। গত ৯ আগস্ট রাতে ভজনপুরে বাজারে গেলে সেখানে আমার উপর অতর্কিত হামলা করে মাদকব্যবসায়ীরা। ওই সময় তারা আমার ব্যবসার টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায়। পরে পঞ্চগড়ের আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিই। এ ঘটনায় থানায় মামলা করেছিলাম। কিন্তু কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
ইউপি সদস্য মকবুল হোসেন বাঙ্গালী জানান, কয়েকজন মাদক সেবন ও বিক্রেতার কারণে দিন দিন গ্রামের অসামাজিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা বেশ কয়েকজন হাতে নাতে ধরে বিচার করলেও এতে কোন লাভ হচ্ছে না। তবে আমি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হয়ে আমি আমার জায়গা থেকে চেষ্টা করছি গ্রামটির সমস্যাগুলো সমাধান করার। মাদককারবারিদের বিরুদ্ধে থানায় বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। একাধিকবার বিচার হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদেও। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। উল্টো হামলা শিকার হতে হয়েছে অনেকের।
এই প্রসঙ্গে তেঁতুলিয়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, ভজনপুর ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মাদকের আখড়া বিষয়ে সেখানকার মানুষ থানায় অবগত করেছে। একটি অভিযোগও পেয়েছি। সেটি তালিকাভুক্তি করেছি। বিশেষ করে এ থানায় নতুন এসেছি। তবে মাদকের বিষয়ে কোন ছাড় নয়। তদন্ত চলছে।