সড়ক দূর্ঘটনায় হাত হারানো কর্মজীবী নারী চাইলেন আর্থিক সহায়তা \ কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিলেন পঞ্চগড়ের ডিসি

পঞ্চগড়\ ঢাকায় ১২ বছরের বেশি সময় পোশাক শ্রমিকের কাজ করেছিলেন শাহানা খাতুন (৩৫)। করোনা মহামারিতে কারখানা বন্ধ হলে স্বামীসহ চলে আসেন পঞ্চগড়ে। এরপর পোশাক শ্রমিকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পঞ্চগড়ে কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। পুঁজি সংগ্রহে একটি বেসরকারি সংস্থায় ঋণ আবেদনও করেছিলেন। ঋণ নিয়ে নিজেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। করোনা মহামারীতে কর্মের সাথে সহায়-সম্বল হারালেও কাজের দক্ষতায় শক্ত মনোবল ছিল এই কর্মজীবী নারীর। কিন্তু মর্মান্তিক এক সড়ক দূর্ঘটনা সংগ্রামী মনোবল ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় শাহানার।
গত বছরের ২৫ মার্চ ঋণের জন্য ওই সংস্থায় গিয়েছিলেন বোন ফাহিমাসহ। রিকশা যোগে বাড়ি ফেরার পথে একটি ট্রাক তাদের রিকশাটিকে ধাক্কা দেয়। সড়কে ছিটকে পড়েন দুই বোন। তার একটি হাত চাকায় পিষ্ট করে চলে যায় ট্রাকটি। এরপর শুরু হয় করোনার চেয়ে ভয়াবহ আরেক অধ্যায়। চিকিৎসায় শেষ সম্বলসহ নিজের আশ্রয়স্থল বিক্রি করেও সেলাই কাজে দক্ষ হাতটি রক্ষা করতে পারেননি তিনি। বাহু থেকে কেটে ফেলা হয়েছে তার ডান হাত। দুই সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে পঞ্চগড় সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীতে এবং ছোট ছেলে চার বছরের। বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া শাহানার স্বামীর ভাড়ায় চালিত ভ্যানের আয় দিয়ে সংসার চলে না। অভাবের তাড়নায় আর্থিক সহায়তার জন্য গত বুধবার পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসকের কাছে এসেছিলেন তিনি।
শাহানার বোনের বাড়ি পঞ্চগড় পৌরসভার পূর্ব জালাসী মহল্লায়। নিজের ভিটামাটি না থাকায় শাহানা স্বামী সন্তান নিয়ে বোনের বাড়িতেই থাকেন। বোন ফাহিমাও শাহানার সাথে সড়ক দূর্ঘটনায় মারাত্বক আহত হন। তিনিও চিকিৎসায় সহায়-সম্বল হারিয়ে তার ভিটাবাড়িটিও বিক্রির প্রস্তুতি নিয়েছেন। করোনায় কাজ হারিয়েছেন, সড়ক দূর্ঘটনায় হাত হারিয়েছেন, এখন বোনের আশ্রয়টুকুও হারাতে বসেছেন। সব হারিয়ে দিশেহারা এই কর্মজীবী নারী এখনও কাজ করতে চান। কারো কাছে ভিক্ষার হাত পাততে চান না। জেলা প্রশাসনের নিয়মিত গণ শুনানীতে এক সময়ের পোষাক শ্রমিক শাহানার জীবনের গল্প শোনেন পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম। তিনি আদম্য শাহানার ইচ্ছে শক্তিকে গুরুত্ব দেন, তাকে জীবন সংগ্রামে সাহস জোগান। জেলা প্রশাসক নিজেও তাকে একজন নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। এরপর আবারও তাকে অফিসে ডেকে নেন জহুরুল ইসলাম। একটি আধুনিক এবং বৈদ্যুতিক সেলাই মিশিন দেন। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে আশ্রয়ের কথা বলেন। মেয়ের স্কুলে যাওয়ার জন্য একটি বাইসাইকেল প্রদানেরও আশ^াস দেন।
আর্থিক সহায়তা চাইতে এসে কর্মসংস্থানের মত স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন শাহানা। চোখের পানি মুছে শাহানা বলেন, ‘আমি ১২ বছরের বেশি সময় ঢাকায় পোষাক শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছি। সেখানে ট্রেড ইউনিয়নের লিডার ছিলাম। সেলাইসহ কাটিং এর কাজ জানা আছে। যে কোন পোশাক কাটিং করে সেলাই করতে পারব। অটোমেটিক সেলাই মেশিনে এক হাত দিয়েও কাজ করতে পারছি। এছাড়া সহযোগিতার জন্য আমার মেয়ে আছে। আমি ভিক্ষার মত কারো কাছে হাত পাততে চাই না। পোষাক তৈরি এবং বিক্রি করে আবারও সংসারের হাল ধরতে চাই। জেলা প্রশাসক আমাকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় না করে সম্মানজনক বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমি আজীবন ডিসি স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।
শাহানার মত জীবনের এমন অসংখ্য গল্প নিয়ে প্রতি বুধবার জেলা প্রশাসকের অফিসে আসেন মেধাবী শিক্ষার্থী, দুঃস্থ, অসহায়, গরীব রোগীসহ নানা সমস্যার মানুষ। এদের কেউ কর্মসংস্থান চান, কেউ আবার চিকিৎসার খরচসহ মৌলিক অধিকার রক্ষায় আর্থিক সহায়তা চান। জহুরুল ইসলাম পঞ্চগড়ে জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদানের পর থেকে প্রতি বুধবার নিয়মিত গণশুনানী করেন। এজন্য দিনদিন গণ শুনানীর সারিও দীর্ঘ হতে থাকে। বিশেষ করে গণ শুনানীতে জীবন নিয়ে গল্প বলা মানুষরা অফিসে ঢুকার প্রথমেই তাদের বিস্কুট এবং শিশুদের চকলেট দিয়ে আপ্যায়ন করেন জেলা প্রশাসক। এরপর সকলের কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনেন। এদের অনেকে মেধাবী শিক্ষার্থী মেডিক্যাল কলেজ বা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও আর্থিক অনটনে ভর্তি হতে পারছেন না, অর্থাভাবে অনেকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না, কর্মসংস্থান বা আশ্রয়ের সুযোগ খুঁজেন অনেকেই।
গত বছরের ২২ জুন (২২.০৬.২০২১) পঞ্চগড়ে জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদানের পর দেড় বছরে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া আটজন শিক্ষার্থীকে তিনি মেডিক্যাল কলেজে এবং ২০ জন গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীকে পাবলিক বিশ^ বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছেন। এ পর্যন্ত ২২১ জনকে শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ^ বিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া রোকনুজ্জামান নামে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এক শিক্ষার্থীকে একটি ল্যাপটপ প্রদান করেন। সাহিত্য চর্চায় অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক রফিকুল ইসলামকে প্রিন্টারসহ একটি ল্যাপটপ প্রদান করেন।
জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম নিজেও জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া শেষ করে ২৪ ব্যাচ এ বিসিএস করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়সহ মাঠ পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ছিলেন। সর্বশেষ তিনি আবারও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে গত বছরের জুনে পঞ্চগড়ে জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন। দেড় বছরে তিনি পঞ্চগড়কে দেশের প্রথম শতভাগ ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত জেলা করেন, এখানে শতভাগ স্কাউটস জেলা প্রতিষ্ঠা করেন, শতভাগ অনলাইন ভূমিসেবা চালু করেন, চা বাগানসহ ৭৪ একর সরকারি জমি দখনমুক্ত করেন, সার্কিট হাউজ, ডিসি বাংলোসহ তেঁতুলিয়ার পর্যটন এলাকার বেশ কিছু স্থাপনার দৃষ্টিনন্দন রুপ দেন।
জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘শাহানা অনেকের মতই গণশুনানীতে এসেছিলেন আর্থিক সহায়তার চাইতে। কথা বলার সময় দেখি তার একটা হাত নাই। এরপর তার জীবন সংগ্রামের গল্প শুনি। তাকে স্থায়ীভাবে আয় করার জন্য একটি ইলেক্ট্রিক সেলাই মেশিন দেওয়া হয়। আর্থিক সহায়তায় কোন কাজ হতো না। এখন তিনি সংসারের হাল ধরবেন। নিজেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন। জন প্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত বিশেষ অনুদান, জাতীয় সমাজ কল্যাণ পরিষদ, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দসহ জেলা প্রশাসক শিক্ষা বৃত্তি থেকে এসব গরীব মেধাবী ও দুস্থ্যদের আর্থিক সহায়তা করা হয়। এটা জেলা প্রশাসনের একটি অন্যতম দায়িত্ব বলেই আমি মনে করি’