ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি\ ২০২৪ সালের জুলাই মাসকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের পুনর্জন্মের মাস। তবে নতুন এই বাংলাদেশের পরিচয় ধারণ করার জন্য ঝরেছে অগণিত মানুষের রক্ত,আহত হয়েছেন অজস্র। সে সময় ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে পথে নেমেছিল সকল শ্রেণি পেশার মানুষ । তাদের মাঝে অনেকেই ঘরে ফেরেননি, কেউ কেউ ফিরেছেন শরীরে ক্ষত নিয়ে, কেউ হারিয়েছেন অঙ্গ, কেউ হারিয়েছেন চোখ। যাদেরকে বলা হচ্ছে জুলাই যোদ্ধা। এমনই এক যোদ্ধা দুলাল হোসেন (৩৩)।
জীবিকার তাগিদে জুলাই বিপ্লবের বছর দুইয়েক আগে দুই সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এলাকার ১০/১৫ জনের সাথে রঙের কাজ করতে রাজধানী ঢাকায় গিয়েছিলেন দুলাল হোসেন। চেখে-মুখে ছিল তার স্বপ্ন আর সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি; কিন্তু ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের স্বেচ্ছারিতার শেষ অস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে চালানো গুলিই যেন আজ তাঁর কাল হয়ে দাড়িয়েছে, পাল্টে দিয়েছে বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
স্বৈরাচার-অত্যাচারী ফেসিষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের একটি বুলেট পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম দুলালের স্বপ্ন ভেঙ্গে করে দিয়েছে খান-খান। থমকে গেছে জীবন । বেঁচে থাকাও যেন দুর্বিসহ এক যন্ত্রনায় পরিণত হয়েছে। একদিকে নিজের চিকিৎসা করে বেঁচে থাকা অন্যদিকে তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় নির্বাক কর্মক্ষম দুলাল।
এ ঘটনার পর আরও নির্বাক করে দুলাল হোসেনের স্ত্রী; কারণ স্বামীর এমন অবস্থায় দুই সন্তান ও স্বামীকে ফেলে রেখে চলে যান তিনি। বন্ধ করে দেয় যোগাযোগ।
দুলাল হোসেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার পৌর শহরের ৬নং ওয়ার্ডের পূর্ব রামচন্দ্রপুর গ্রামের জাহেরুল ইসলামের ছেলে। তিনি পেশায় একজন রং মিস্ত্রি।
বর্তমানে সরকারি সহায়তায় দেশের বাহির থেকে চিকিৎসা করে আসার পরও ক্র্যাচে ভর করে কষ্টে চলাচল করতে হয়। কোটা আন্দোলনে কোমরে গুলিবিদ্ধ হন দুলাল হোসেন। ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের সময় কোমরে গুলি লাগার পর এখনো স্বাভাবিক জিবনে ফিরতে পারেনি দুলাল। ঘটনার পর কোলের একটি কণ্যা শিশু সন্তানকে নিয়ে তার স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। বর্তমানে এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বাড়ীতে বসবাস করেন দুলাল। আগেরমত আর কাজও করতে পারেন না।
দুলাল হোসেন এই প্রতিবেদককে জানান, জুলাইÑআগষ্ট বিপ্লবের শেষ মুহূর্তে ৫ আগষ্ট বিকেল ৫টায় ঢাকার উত্তরা-আজিমপুর এলাকায় আন্দোলনরত মিছিলে নির্বিচারে গুলি ছোড়ে পুলিশ, সে সময় ১টি গুলি দুলাল হেসেনের কোমরের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বাম পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। গুলিবিন্ধ দুলাল তখন রক্তাক্ত অবস্থায় সড়কে পড়ে কাতরাতে থাকে। এসময় গুরুত আহত অবস্থায় স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে উত্তরা লেক ভিউ মেডিকেলে ভর্তি করান। সেখানে তাঁর একটি অপারেশন করা হয়। সেই অপারেশনে সবমিলিয়ে তার প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ হয়। পরবর্তীতে ২২ আগষ্ট পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করানোর হয় তাকে। এরপর আরও একটি অস্ত্রপাচার করা হয় সেখানে । সর্বশেষ দেশের বাইরে ব্যাংককে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। ফেব্রয়ারী মাসে দেশের বাইরে গিয়ে প্রায় চার মাস চিকিৎসা শেষে ১৮ জুন দেশে ফেরেন দুলাল হোসেন। কিন্তু চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরলেও এখনো স্বাভাবিক জিবনে ফিরতে পারেনি দুলাল । নিজে একজন কর্মহিন মানুষ, এর ওপর সংসারে নেই তার স্ত্রী, ঘরে ছোট ছোট সন্তান। তাদের দেখাসুনা কে করবে? কি হবে সন্তানদের ? কিভাবে চলবে তার সংসার ? এইসব দুশ্চিন্তায় দুলাল যেন চারিদিকে অন্ধকার দেখছে দুলাল।
জানতে চাইলে দুলাল আক্ষেপ করে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসা আর দুই লাখ টাকা হয়ত পেয়েছি। কিন্তু তা দিয়ে কি হবে? আমিতো আর আগেরমত স্বাভাবিক জিবনে ফিরতে পারব না? কোন কাজও করতে পারব না। ছোট তিনটি বাচ্চাকে কিভাবে মানুষ করব? সরকার যদি আমাকে স্থায়ীভাবে আয়ের কোন উৎস গড়ে দিত তাহলে অন্তত খেয়ে পরে সন্তানদের মানুষ করতে পারতাম।
দুলাল আরও বলেন, ঘটনার পর চিকিৎসার জন্য প্রথমে যে সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে তা আত্মীয়-স্বজনরা দিয়েছেন। সেই টাকাও শোধ করতে পারিনি। একে তো কর্ম নেই, অন্যদিকে সন্তানদের খরচসহ সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে,সেইসাথে মাথায় রিনের বোঝা।
চিকিৎসা প্রসঙ্গে দুলাল বলেন, পায়খানা ও প্র¯্রাবের রাস্তা অপারেশনের মাধ্যমে এক করে দিয়েছে। এতে অনেক সমস্যা, জানি না আগামীতে কি হবে? সাথে একটা ভাবনা তো আছেই। আমার সন্তানদের কী হবে ?
দুলালের বাবা জাহেরুল ইসলাম বলেন, হয়তো জীবন বেঁচে গেছে, কিন্তু আমার ছেলে কি আর আগের মতো চালাচল কিংবা কাজ করতে পারবে ?। সরকারের পক্ষ থেকে তাকে যদি এমন কোন ব্যবস্থা করে দেয়া হতো, যাতে করে সে তার সন্তানদের মানুষ করাসহ জীবিকানির্বাহ করতে পারে।
ফুলবাড়ী পৌরসভার সদ্য সাবেক মেয়র আলহাজ¦ মাহমুদ আলম লিটন বলেন, পৌর এলাকার বাসিন্দা দুলাল। দেশের জন্যই গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন পঙ্গু। বাড়ির অবস্থাও তেমন ভাল না। এই ঘটনার পর স্বামীকে (দুলালকে) রেখে তার স্ত্রীও চলে গেছে। ঘরে ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে করুণ ভাবে জীবনযাপন করছে। সরকারের উচিত এই জুলাই যোদ্ধার জন্য স্থায়ীভাবে কিছু করে দেয়া। যাতে সেই আয় থেকে সে তার সন্তানদের মানুষ করে চলতে পারে।