রক্তে যার নাটকের নেশা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কিংবদন্তি আমাদের কড়ি দা

ঠাকুরগাঁও : উত্তরের জেলা শহর ঠাকুরগাঁওয়ের এক সময়ের মঞ্চ কাঁপানো নাট্যাভিনেতা, নির্দেশক, মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে অংশগ্রহনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা রুপ কুমার গুহ ঠাকুরতা। কড়ি দা নামের যার ব্যাপক পরিচিতি। ঠাকুরগাঁওয়ের নাট্যাঙ্গন ও রুপকুমার গুহ ঠাকুরতা এক অবিচ্ছেদ্য দুটি নাম। বিগত ৫ দশক ধরে ঠাকুরগাঁওয়ের নাট্যাঙ্গনকে তিনি আলোকিত করে রেখেছেন। রক্তে যার মিশে আছে নাটকের নেশা। বর্তমানে তিনি ঠাকুরগাঁওয়ের নাট্যাঙ্গনকে আগলে রেখেছেন। তিনিই সাংস্কৃতিক মহলের অভিভাবক।
নাট্যকর্মী রুপকুমার গুহ ঠাকুরতা ১৯৫৬ সালের মে মাসে ঠাকুরগাঁও শহরের আশ্রমপাড়ায় জন্মগ্রহন করেন। বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের জনপ্রিয় নাট্য অভিনেতা বাবা হরিদাশ গুহ ঠাকুরতা যিনি গোঁসাই বাবু নামে পরিচিত। তাঁর হাত ধরে নাট্যমঞ্চে প্রবেশ করেন। তখন তাঁর বয়স কেবলমাত্র আট। সেই থেকে নাট্যাঙ্গণে পথচলা শুরু। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ১৯৭৩ সালে তিনি ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন।
রুপকুমার গুহ ঠাকুরতার অভিনীত ৯৮টি নাটক ও যাত্রা মঞ্চস্থ হয়েছে দুই শাতাধিক বার। বাবার কাছে নাটকের হাতে খড়ি হলেও তিনি ঠাকুরগাঁওয়ের শিশুশিল্পী হিসেবে মঞ্চে পা রাখেন। তারপর হাঁটি হাঁটি পা-পা করে শুধুই এগিয়ে চলা। আবার এভাবেই কড়িদার অভিনীত ৮০টি নাকের প্রায় ২শ টি প্রদর্শনী হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অভিনয় করেছেন দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনের কিংবদন্তিতুল্য অভিনেতা-অভিনেত্রী আনোয়ার হোসনে ও আনোয়ারার সঙ্গে। এছাড়াও কড়িদা দেশের অনেক প্রথিতযশা বেতা, টিভি ও চলচ্চিত্র অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে মঞ্চে অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নবাব সিরাজদৌল্লা, ফিঙ্গার প্রিন্ট, চারিদিকে যুদ্ধ, স্পেন বিজয়ী মুসা, যদি আমি কিন্তু আমি, নীল দর্পন, ক্যাপ্টেন হুররা, বিসর্জন, ডাকঘর, জমিদার দর্পন, সেনাপতি, এখনও ক্রীতদাস ইত্যাদি।
১৯৭১ সালে প্রাণের টানে যোগ দিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। ছিলেন ৬ নাম্বার সেক্টরে। কমান্ডিং অফিসার আবুল বাশারের নেতৃত্বে সম্মুখসমরে অংশ নিয়েছেন হলদীবাড়ী, চিলাহাটি, আমবাড়ি, মির্জাগঞ্জ এলাকায়। যুদ্ধ করতে করতে চোখের সামনেই দেখেছেন অনেক সহযোদ্ধাকে মৃত্যুবরণ করতে। দেশ স্বাধীনের নেশায় তখন এতটুকু বয় পাননি এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন করেই ফিরে এসেছেন কড়িদা। জীবনের বলা না বলা গল্প, সমাজের জানা অজানা কাহিনী অথবা আমাদের আশে পাশে চলাফেরা করা নানান মানুষের নানা চরিত্রের সম্মিলন ঘটে মঞ্চ নাটকের স্বচ্ছ দর্পণে। মঞ্চের ভাষায় প্রকাশিত হয় নানা হাসি-কান্নার ছায়াপাত, উচ্চারিত হয় ন্যায়-অন্যায়ের প্রতিবাদ বাক্য, পর্দা উন্মোচন হয় সত্য-অসত্যের পূর্বাপরের। এমনই দৃঢ় শক্তি নিহত শিল্পের অন্যতম অঙ্গ মঞ্চ নাটকের বাহুবলে। নাটক চর্চায় ঠাকুরগাঁওয়ের প্রগতিশীল মানুষগুলোর অন্যতম একজন রুপকুমার গুহ ঠাকুরতা। কড়ি দা নামেই যার ব্যাপক পরিচিত।
ঠাকুরগাঁও নাট্য সমিতির প্রযোজনা “সেতু” নাটকে প্রথম অভিনয়। পরবর্তিতে নাট্য জীবনের পথ চলা এরপর আর থেমে থাকেনি। সম্পৃক্ত হয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন নাট্য সংগঠনের সাথে। তার নাট্য প্রতিভার সৃজনশীল ছায়াপাত ঠাকুরগাঁওয়ের নাট্যাঙ্গনের জন্য আর্শিবাদ হয়ে সমৃদ্ধ করেছে। তার অভিনয়, নাট্য চিন্তা বরাবরই সুধী মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। স্থানীয় নাট্য শিল্পীদের সাথে অভিনয়ের পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী আনোয়ার হোসেন, আনোয়ারা, নার্গিস খান জয়নুল, মিনু রহমান, অঞ্জু ঘোষ, পাপিয়া সহ অনেকেরসাথে সহ শিল্পী হিসেবে অভিনয় করে সদামত হয়েছেন। এছাড়াও তিনি ঠাকুরগাঁও নাট্য সমিতি, ঠাকুরগাঁও নাট্য গোষ্ঠী, তরুন সংঘ, শাপলা নাট্য গোষ্ঠী, গ্রীন থিয়েটার, যাত্রিক নাট্য গোষ্ঠী, ও ঢাকার সংলাপ নাট্য গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। রুপকুমার গুহ ঠাকুরতা জেলা শিল্পকলা একাডেমী, ঠাকুরগাঁওয়ে নাট্য প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রুপকুমার গুহ ঠাকুরতা শুধু অভিনেতাই নন তিনি একজনসফল নাট্য নির্দেশকও। তার অভিনীত ও নির্দেশিত নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সেতু, এখনও ক্রীতদাস, সেনাপতি, চারিদিকে যুদ্ধ, ইনসপেক্টর জেনারেল, নবাব সিরাজ উদ দৌলা, অন্ধকারের নিচে সুর্য, এছাড়া তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য যাত্রা প্রয়োজনা, একটি পয়সা, অনুসন্ধান, অশ্র দিয়ে লেখা, মা মাটি ও মানুষ, এই পৃথিবী টাকার গোলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা রূপকুমার গুহ ঠাকুরতার আত্মায় যেমন মিশে আছে দেশপ্রেম, তেমনি তার শিল্প সত্ত¡ায় মিশে আছে নাটকের নিবিড় টান। তিনি তার নাট্য প্রতিভার আলো অনুজদের মাঝে ছড়িয়ে আলোকিত করেছেন সবসময়। নাটক এবং নাট্য শিল্পের সর্বোচ্চ শিখাকে ছোঁয়া তার বেঁচে থাকার স্বপ্ন।