আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বৃীকৃতি,পৃথক মন্ত্রনালয় ও ভুমি কমিশন গঠন,সিধু-কানু‘র ভার্স্কয্য ভাংচুরকারী বিচার ও অনতিবিলম্বে ভার্স্কয্য পূন:নির্মানসহ সারাদেশে আদিবাসীদের লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে দিনাজপুরের কাহারোলের তেভাগা চত্বরে আদিবাসীদের প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষনা।
মঙ্গলবার বেলা ১২টায় দিনাজপুর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এসময় লিখিত বক্তব্যে কৃষনা প্রিয়া সরেন বলেন, গত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দেশের সকল স্তরের ছাত্র জনতার ঐক্যবদ্ধ গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হয়েছে। এরফলে দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনা, বৈষম্য থেকে মুক্ত হতে পেরে মুক্তিকামী জনগণ বিজয় মিছিল করেছে। কিন্তু এই আনন্দঘন মুহুর্তেও কিছু গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে সারাদেশে ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ভ‚মি দখল করেছে। আদিবাসীরাও এই অন্যায় অত্যাচার থেকে রেহায় পায়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো আদিবাসী গ্রামগুলোতে আদিবাসীরা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। বেশীরভাগ দুষ্কৃতিকারীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকায় ও বিচারের আওতায় না আসায় আদিবাসীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে আদিবাসীদের উপর হামলা, ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ভুমি দখলের ঘটনার ঘটছে যা অত্যান্ত দু:খজনক। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের আদিবাসীদের আত্মমর্যাদা ও মানবাধিকার সুপ্রতিষ্টিত হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ দেশের আদিবাসীদের রয়েছে বিশাল অবদান। বিপুল সংখ্যক আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে এবং জীবন দিয়েছে। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর নিজ দেশে এসে আদিবাসীরা দেখলো তাদের বাড়ি-ঘরের কোন চিহ্ন নেই, চাষের জমি ও ভিটা-মাটি দখল হয়ে গেছে। অনেকেই বেদখল হওয়া জমি আজও ফেরত পায়নি। বর্তমান সময়ে আদিবাসীদের জীবন সংকটাপুর্ন হয়ে পড়েছে এবং তাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি ক্রমাগতভাবে চরম অবনতি ঘটছে। আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা দিনদিন আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। এক শ্রেণীর ভূমিদস্যু ও সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন সময় আদিবাসীদের উপর অত্যাচার, ভূমি থেকে উচ্ছেদ, জাল দলিল, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, মিথ্যা মামলা, লুটপাট, জবর দখল, দেশ ত্যাগে বাধ্যসহ নানা ধরনের নির্যাতন নিপীড়ণ চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আদিবাসীরা এখন নিজ দেশে পরবাসীর ন্যায় জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। আদিবাসীদের উপর নিপীড়ণ, ভূমি দখল, উচ্ছেদ, ধর্ষণ, হত্যার মামলায় থানা পুলিশ, স্থানীয় অসৎ জনপ্রতিনিধি ও ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভূমিদস্যু ও সন্ত্রাসীদের পক্ষাবলম্বন করে সহায়তা করে আসছে। ফলে আদিবাসীরা আরও অসহায় হয়ে পড়ছে। অতীতের অনেক সরকার আদিবাসীদের ভূমি অধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নের অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে কেউ কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। আদিবাসীদের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠায় বেশীরভাগ রাজনৈতিক দলগুলোর ভুমিকা অনেকটা নীরব এবং অনেক ক্ষেত্রে ভূমি দস্যূরা রাজনৈতিক ছত্রছায়াকে কাজে লাগিয়েই আদিবাসীদের ভূমি দখলে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
নওগাঁর বহুল আলোচিত আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন হত্যা, দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার ঢুডু সরেনসহ তার ভাই ও পিতাকে হত্যা, পার্বতীপুর উপজেলার চিড়াক‚টা গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা, সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মে বাপ-দাদার সম্পত্তির দাবিদার তিন সাঁওতাল হত্যাসহ ১৮৪২.৩০ একর সম্পত্তি ফেরত দানে গড়িমসি, রুখিয়া রাউত ধর্ষণ ও হত্যা, নবাবগঞ্জে বন বিভাগ কর্তৃক আদিবাসীদের জমি দখল ও আদিবাসীদের নামে মিথ্যা বন মামলা প্রদান ইত্যাদি ঘটনার কোনটিরই ন্যায্য বিচার আদিবাসীরা আজো পায়নি। এমনকি দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে যেসব আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করেছেন তাদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পর্যন্ত পাননি। অনেক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাও দেশ স্বাধীন পরবর্তী সময়ে ভ‚মিদস্যুদের অত্যাচার ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে পরিবারসহ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদু উরাও এর নেতৃত্বে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আদিবাসীরা তীর ধনুক নিয়ে আক্রমণ করেছিল কিন্তু সেই বুদু উরাওকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল।
আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোন সরকারই স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ফলে আদিবাসীদের প্রথাগত সামাজিক ব্যবস্থা আজ প্রায় বিলুপ্ত। আদিবাসীদের সংরক্ষিত পবিত্র-প্রথাগত ভূমি-বনভূমি-জলাভূমি-জলাশয়-বৃক্ষ-দেবস্থান-মন্দির-উৎসব ও মেলা এলাকা-প্রার্থনা এলাকা স্ব স্ব আদিবাসীদের সামাজিক রীতি ও আইনের মাধ্যমে পরিচালনার অধিকার থাকলেও কোন সরকার তা সুরক্ষা করতে পারেনি। সর্বোপরি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীদের প্রতি স্বাধীনতা পরবর্তী সকল সরকারই জাতিবিদ্বেষী আচরণ জারি রেখেছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বৈষম্য আদিবাসীদের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করেছে। সংবিধানে কোনমতে আদিবাসীরা নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও আদিবাসীদের স্ব স্ব ভাষা, ধর্মসমূহ অস্বীকৃতই রয়ে গেছে। সম্প্রতি ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে সেখানে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার যে অঙ্গীকার ব্যক্ত হচ্ছে সেটা দেখে আদিবাসীরা আবারো কিছুটা আশার আলো দেখতে পেয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উপরোক্ত বিষয়সমূহের বিষয়ে আদিবাসীরা তাদের উপর ঘটে যাওয়া অন্যায় অত্যাচারের বিচারসহ বিভিন্ন দাবিতে আজ ২৮ আগস্ট সকাল ১০টায় দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলার তেভাগা চত্বরে (কান্তনগর মোড়) প্রতিবাদ সমাবেশ করবে।
এসময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মানিক সরেন,ঈশ্বর টুডু,রিপন মার্ডি,নারায়ন মার্ডি ও দুলাল সরেন।