চিরিরবন্দর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি: নিরক্ষরতা দূরীকরণে লক্ষ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠা বালাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে খানসামা উপজেলায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।
জানা গেছে, উপজেলার খামারপাড়া ইউনিয়নের বালাপাড়া গ্রামের সমাজসেবক আব্দুল বজস হাজী এলাকাকে নিরক্ষরমুক্ত করতে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এজন্য তিনি জমি দান করেন। ১৮৯২ সালে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যালয়টি। প্রতিষ্ঠানটির শুরুর দিকে নিরক্ষরমুক্ত এলাকা গড়তে স্থানীয়দের ব্যবস্থাপনায় বাঁশের বেড়া-টংয়ে প্রতি সন্ধ্যায় ক্লাশ নেয়া হতো। কালের পরিক্রমায় এই প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রুপ লাভ করে। সরকারি বিধি মোতাবেক ১৯৫৮ সালে এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান গৌরাঙ্গ চন্দ্র রায়। গত ২০০৮ সালে এ বিদ্যালয়ে বর্তমান প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম যোগদান করে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সেই সময় থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও আশপাশের পরিবেশের।
বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার পাকেরহাট থেকে বোর্ডেরহাট যাওয়ার রাস্তার পাশেই বালাপাড়া নামক স্থানে বিদ্যালয়টি অবস্থিত। এ বিদ্যালয়ের পাশেই রয়েছে বালাপাড়া দাখিল মাদরাসা। মূল সড়ক দিয়ে প্রবেশ করলেই দেখা যায় ক্লাশ শুরুর পূর্বে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া ও দৈনিক সমাবেশ। আরও চোখে পড়বে নির্মাণাধীন একটি ভবনসহ তিনতলা বিশিষ্ট দুইটি ভবন, শ্রেণিকক্ষ, ফুলের বাগানসহ খেলার মাঠ। মূল ভবনে রয়েছে প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের কক্ষ। বিদ্যালয়ের দেওয়ালে সুসজ্জিত প্রাক-প্রাথমিকের শ্রেণিকক্ষ, সততা ষ্টোর ও দেয়াল লিখন। তবে বিদ্যালয়ের কিছু অংশে সীমানা প্রাচীর ও মূল গেট না থাকায় সাধারণ মানুষের চলাচলের কারণে প্রায়ই বিপত্তি ঘটে থাকে।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৪৩১ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। অপরদিকে, তদারকি ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নরত রয়েছে ৫১ জন শিক্ষার্থী। এদের পাঠদানের জন্য রয়েছেন প্রধান শিক্ষকসহ ১০ জন শিক্ষক। শিক্ষকেরা জানান, শিক্ষার্থীর সংখ্যার তুলনায় শিক্ষক অপ্রতুল হওয়ায় পাঠদানে ভোগান্তি পোহাতে হয়। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, শিক্ষকদের স্বদিচ্ছা, পাঠদান ও সুষ্ঠুভাবে বিদ্যালয়টি পরিচালনার কারণে উপজেলায় শ্রেষ্ঠ হয় এ বিদ্যালয়টি। আরও জানা গেছে, পরীক্ষা পদ্ধতি উঠে যাওয়ায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এজন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি ও উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মোবাইলে ম্যাসেজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর প্রতিদিনের উপস্থিতির তথ্য অভিভাবকদের অবগত করানো হয়। এছাড়াও নিয়মিত হোম ভিজিট, উঠান বৈঠক, অভিভাবক ও মা সমাবেশ করে থাকেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম গত ২০২৩ সালে উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হক গবেষণা পরিষদ থেকে পুরস্কৃত হন। এছাড়াও চলতি বছর এ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোছা. মাহফুজা বানু উপজেলার শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। বিগত কয়েক বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দেয়ার পূর্ববর্তী সময়ে জিপিএ-৫, ট্যালেন্টপুল ও সাধারণ বৃত্তিতে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। বালাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি চলতি বছরসহ কয়েকবার শিক্ষা, ক্রীড়া ও বিভিন্নক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। এছাড়াও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ সৃজনশীল নানা আয়োজনে এ বিদ্যালয়ের রয়েছে সরব উপস্থিতি।
অভিভাবক রবিউল ইসলাম বলেন, বর্তমান সময়ে প্রাইভেট স্কুলের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেলেও এ বিদ্যালয় একেবারে ব্যতিক্রম। এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও শিক্ষকদের আগ্রহ তুলনামূলক অনেক ভালো। উপজেলার সেরা এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে। এ বিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষার্থীরা প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষকসহ দেশ সেবায় বিভিন্ন পদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
সাবেক শিক্ষার্থী ও বিসিএস (সড়ক ও জনপথ)’র ৩৭ ব্যাচের কর্মকর্তা মো. আমানউল্লাহ আমান বলেন, এ বিদ্যালয়টি আমাদের প্রত্যন্ত অজপাড়াগাঁয়ে হলেও শিক্ষকদের আন্তরিকতা এবং স্থানীয়দের সহযোগিতায় বরাবরই ফলাফল অন্যান্য বিদ্যালয়ের তুলনায় ভালো করে থাকে। এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সন্তানের মতো আদর-যতœ করেন। বিদ্যালয় সময়ের পরেও বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে পড়িয়ে থাকেন। এরকম একটি বিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পেরে আমি নিজে গর্ববোধ করি।
প্রধান শিক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, এ বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই বিভিন্ন সময় নানা প্রতিবদ্ধকতা, সীমিত সামর্থ্য নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। তারই স্বীকৃতি স্বরুপ এ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন। তিনি আরও বলেন, সমাজের সবারই সহযোগিতা পেলে আগামীতে এ প্রতিষ্ঠানটিকে আরো উন্নত ও দৃষ্টিনন্দন করা সম্ভব হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. তাজ উদ্দিন বলেন, প্রত্যেক মানুষের জীবনে পরিবারের পরেই মূল ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। এই প্রাথমিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে বালাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ বিদ্যালয়ের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি এবং যেকোনো প্রয়োজনে সর্বদাই উপজেলা প্রশাসন তাদের পাশে থাকবে।