সবুজ পাতার ভেতর হলুদ, কোথাও পিংক-বেগুনি আবার কোথাও নীল রঙ। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, ফুটে আছে সুন্দর কোন ফুল। তবে এটা ফুল নয়, শীতকালীন সবজি ফুলকপি এবং বাঁধাকপির ক্ষেত। মনোরম এই দৃশ্য চোখে পড়বে দিনাজপুর সদর, বীরগঞ্জ ও বিরল উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে।
৯ ফেব্রæয়ারি সকালে দুপুরে ওই গ্রামে ক্ষেত ঘুরে দেখা যায়- চাষ করা হলুদ, গোলাপি ও হালকা লাল রঙের বাহারি ফুলকপি এখন শোভা পাচ্ছে তার জমিতে। যা শুধু দৃশ্যমান সৌন্দর্যই বাড়ায়নি, বাজারেও এনেছে বিপুল সাড়া।
কৃষি বিভাগের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে দিনাজপুরের বেশ কয়েকটি উপজেলায় বিস্তীর্ণ ক্ষেতজুড়ে রঙিন ফুলকপি ও বাঁধাকপির চাষ হচ্ছে। পোকা দমনেব্যবহার করা হচ্ছে জৈব বালাইনাশক ফরোমন ফাঁদ ও হলুদ ট্যাপ। ফলনও হচ্ছে বেশ ভালো। বাজারে ব্যাপক চাহিদা হওয়ায় ভালো দাম পাচ্ছেন কৃষকরা।
জানা গেছে, চলতি মৌসুমে অন্যান্য সবজি চাষ করে যে লোকসান হয়েছে, সেই লোকসান পুষিয়ে নিতে পারছেন কৃষকরা। পাইকাররা এসে ক্ষেত থেকেই নিয়ে যাচ্ছেন ফুলকপি। স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি রঙিন ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। ফলে রঙিন ফুলকপি ও বাঁধাকপির সাফল্যে খুশি কৃষকরা।
বীরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়া, ভোগনগর ও সাতোর ইউনিয়নের রঙিন ফুলকপি চাষিরা বলছেন, সাদা কপি ৫টাকায় বিক্রি হলেও এ কপি এখনও বাজারে প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়।
বীরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়া ইউনিয়নের দামাইক্ষেত্র গ্রামের সবজি চাষি কুশল চন্দ্র রায় ২০ শতাংশ জমিতে চাষ করেছেন রঙিন ফুলকপি। তিনি পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারের মতো রঙিন ফুলকপি চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন। চারা ছাড়াও ফুলকপি চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জৈব সার, কীটনাশক ও পরামর্শ দিয়ে তাকে সহযোগিতা করেছে উপজেলা কৃষি অফিস।
কুশল চন্দ্র রায়ের মতো ভোগনগর ও সাতোর ইউনিয়নের আরও চারজন রঙিন ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষীদের এনে দিয়েছে সাফল্য। সাদা ফুলকপি যেখানে বিক্রি হয় প্রতি পিস ৫ থেকে ৬ টাকায়, সেখানে তার চাষ করা রঙিন ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। ইতোমধ্যেই ৭ হাজার টাকার ফুলকপি বিক্রি করেছেন কুশল। তিনি আশা করছেন, বাকি ফসল থেকে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করবেন। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে চাষ করার পরিকল্পনাও রয়েছে তার।
কৃষি অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী কুশল চন্দ্র রায় জৈব পদ্ধতিতে চাষ করেছেন এই রঙিন ফুলকপি। পোকামাকড় দমনের জন্য ব্যবহার করেছেন হলুদ ফাঁদ, যা কপিগুলোকে করেছে স্বাস্থ্যকর এবং বিষমুক্ত।
বীরগঞ্জ পৌর বাজারের সবজি ব্যবসায়ী মো. মোজাম্মেল বলেন, ‘এ কপির পুষ্টি এবং গুণাগুণ অনেক ভালো। রঙিন ফুলকপি বাজারে আসা মাত্রই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। দামও মিলছে আশানুরূপ।
স্থানীয় ক্রেতা আশারুল জানান, ২৫ টাকা দরে রঙিন ফুলকপি কিনেছেন তিনি। দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, খেতেও তেমনি সুস্বাদু। এর আগে দুইবার খেয়েছেন। তাই আবারও নিলেন।
বীরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এই রঙিন ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষে কৃষকরা আশানুরূপ ফলন ও বাজারমূল্য পেয়েছেন। রঙিন ফুলকপির পুষ্টিগুণ সাদা ফুলকপির তুলনায় অনেক বেশি এবং এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এ বছর বীরগঞ্জ উপজেলায় ৭০২ হেক্টর জমিতে ফুলকপি চাষ হয়েছে এবং এর মধ্যে ২৫ একর জমিতে রঙিন ফুলকপি চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাজারে এর উচ্চ চাহিদা থাকায় আগামী বছর আরও বেশি কৃষক এই চাষে যুক্ত হবেন।’
দিনাজপুরের সদর উপজেলার দিঘন, জংগলপাড়া ও মহব্বতপুরের বিস্তীর্ণ ক্ষেত জুড়ে ব্যতিক্রমী শীতকালীন সবজি রঙিন ফুলকপি চাষ করেছেন কৃষকরা। কোনোটি হলুদ, কোনোটি পিংক-বেগুনি। আর এসব ফুলকপি কোনও প্রকার কীটনাশক ছাড়াই জৈব বালাইনাশক ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারেই এই ফুলকপি করা হচ্ছে।
শেখপুরা ইউনিয়নের দিঘইন জংগলপাড়া গ্রামের কৃষক মো. আলমগীর বলেন, ‘গত বছর তিনি পরীক্ষামূলকভাবে তার ২০ শতক জমিতে ক্যারোটিন জাতের রঙিন ফুলকপি চাষ করে ব্যাপক লাভবান হয়েছেন। তাই এ বছর আড়াই বিঘা জমিতে চাষ করেছেন এই রঙিন ফুলকপি। এবার ক্যারোটিনের পাশাপাশি ইয়োলো স্টার (হলুদ) ও ভেনেটিনা (পিংক) জাতের রঙিন ফুলকপি চাষ করেছি। বাম্পার ফলন হয়েছে। কোনও রোগ বালাই নেই, খরচ কম। লাভ বেশি।’
সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউপির মহব্বতপুর গ্রামের কৃষক রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘মহিলা বহুমুখী শিক্ষা কেন্দ্র-এমবিএসকের কাছে বিনামূল্যে বীজ পেয়ে তিনি দেড় বিঘা জমিতে এই রঙিন ফুলকপির চাষ করেছি। শুধুমাত্র জৈব বালাইনাশক ও ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারেই চাষ করেছি এই ফুলকপি। বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকায় পাইকার ব্যবসায়ীরা ক্ষেত থেকেই ফুলকপি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। দামও ভালো।’
কৃষক ইমতিয়াজ বলেন, ‘প্রথমবারের মতো রঙিন ফুলকপির চাষ করেছি। ফলন বেশ ভালো হয়েছে। চাষে পোকা দমনে ফরোমন ফাঁদ ও হলুদ ট্যাপ ব্যবহার করে ২২ শতক জমিতে প্রায় দেড় হাজার কপি হয়েছে। এতে খরচ হয়েছে মাত্র ১২ হাজার টাকা। বাজারে প্রতিটি কপি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি করছি। এ পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকার কপি বিক্রি করেছি। আরও আছে। লোকজন রঙিন জাতের কপি কিনতে বেশ আগ্রহী। অল্প টাকা খরচ করে আমি বেশ লাভ পেয়েছি। আগামীতে আরও বেশি জমিতে এ জাতের কপির চাষ করব।’
দিনাজপুর সদর উপজেলার পারদিঘন গ্রামের ছামিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাড়ির অদূরে গর্ভেশ্বরী নদীর বাঁধের পাড়ে দুই বিঘা জমিতে সাদা, গোলাপি, সবুজ, হলুদ- চার প্রকারের ফুলকপি এবং ব্রকলি, চায়নিজ ক্যাবেজ, রেড ক্যাবেজ, সাধারণ বাঁধাকপিসহ মোট ১৩ হাজার চারা লাগিয়েছি। ফলনও ভালো হয়েছে। বাজারজাত করে দামও ভালো পেয়েছি। কিন্তু অন্যান্য শীতকালীন সবজি চাষে আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় অনেক আফসোস। তবে রঙিন ফুলকপি ও বাঁধাকপিতে লোকসান পুষিয়ে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি।’
ছামিদুল আরও বলেন, ‘দুই বিঘা জমি এক বছরের জন্য বর্গা নিয়েছি ৬০ হাজার টাকায়। জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু, রসুন, টমেটো লাগিয়েছি। এর মধ্যে ৪ হাজার রঙিন ফুলকপি-বাঁধাকপির চারা স্থানীয় এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিনামূল্যে পেয়েছি। অবশিষ্ট চারাগুলো কিনতে হয়েছে প্রতি পিস ১ টাকা ৮০ পয়সা দরে। এর পর জমি প্রস্তুত, সার, কীটনাশক, শ্রমিকবাবদ খরচ হয়েছে প্রায় এক লাখ টাকা।’
ছামিদুল বলেন, ‘প্রতি পিস কপি যদি ১০ টাকাও দাম পেতাম, অন্তত আসলটা উঠে আসত। কিন্তু বাজারে এখন প্রতি পিস বিক্রি করছি ৫ থেকে ৬ টাকায়। তবে রঙিন ফুলকপিটার দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা পেয়েছি। সেটা দিয়ে লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।’
দিনাজপুর জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তের উপপরিচালক মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গত দুই বছর ধরে জেলায় রঙিন ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ হচ্ছে। চাষ করে সফলতা পেয়েছেন অনেক কৃষক। বাজারে ভাল চাহিদা থাকায় আগামীতে বাণিজ্যিকভাবে রঙিন জাতের এই ফুলকপির চাষ বাড়বে। অন্য কৃষকরাও এ জাতের রঙিন ফুলকপি চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।’
ক্ষেতে কোনো প্রকার কীটনাশক ও সার প্রয়োগ না করে কেবল জৈব পদ্ধতিতে বালাইনাশক ফরোমন ফাঁদ ও হলুদ ট্যাপ ব্যবহার। ফলনও বেশ ভালো। রঙিন ফুলকপি ভেষজগুণ সম্পন্ন একটি সবজি। স্বাদেও ভালো। সাধারণ ফুলকপির তুলনায় রঙিন ফুলকপিতে ২৫ শতাংশের বেশি ক্যারোটিন রয়েছে। যা ত্বক ও চোখকে ভালো রাখে। এটি কোলাজেন ধ্বংস করে। যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এর মধ্যে ভিটামিন এ, সি এবং ক’সহ বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন রয়েছে। এতে রয়েছে মিনারেলস, পটাসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ। সেই সাথে এ ফুলকপিতে প্রচুর পরিমাণে বেটা ক্যারোটিন যা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।’
দিনাজপুর অঞ্চলের টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক আবু রেজা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের সহায়তায় বিভিন্ন উচ্চমূল্যের সবজি যেমন- স্কোয়াশ, ক্যাপসিকাম, রঙিন ফুলকপি, রঙিন বাঁধাকপি, ব্রকলি আবাদ প্রদর্শনী কৃষকদের প্রদান করা হয়েছে। এ বছর দিনাজপুর জেলায় ৫২ হেক্টর জমিতে রঙ্গিন ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ হয়েছে। ভোক্তাদের মাঝে নিরাপদ উচ্চ মানের সবজি উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কৃষি অধিদপ্তর ও কিছু উন্নয়ন সংস্থা কৃষকদের পাশে থেকে সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদানে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। এ কপি দেখতেও যেমন আকর্ষণীয় তেমনি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। এটিতে জ্যান্তফিল, ক্যারোটিনেট, ভিটামিন এ থাকার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, দৃষ্টিশক্তি বাড়ায় ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।’
জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় এবার বাঁধাকপির চাষ হয়েছে ২ হাজার ১২২ হেক্টর জমিতে এবং ফুলকপির চাষ হয়েছে ২ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে রঙিন ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ হয়েছে বেশকিছু জমিতে।