বীরগঞ্জ (দিনাজপুর) প্রতিনিধি\ পিঁয়াজ বীজ চাষে উৎপাদন ও সংরক্ষণে মুনাফা বেশি পাওয়ায় বীরগঞ্জ, বিরলসহ কয়েক উপজেলার কয়েক গ্রামে বেড়েছে পিঁয়াজ বীজ চাষ ও সংরক্ষণের কার্যক্রম। এখন পিঁয়াজ বীজের ক্ষেতে পরিচর্যা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা।
এসব জমিতে আগে গম, ভুট্টা আর আলু বেশি চাষ হলেও লাভের আশায় কয়েকজন কৃষক পিঁয়াজ বীজের আবাদ শুরু করেন।
বীরগঞ্জ উপজেলার ঝাড়বাড়ি ইউনিয়নের কৃষি বিভাগের মাঠ কর্মকর্তা শফিকুর রহমান জানান, চলতি বছর শুধু বীরগঞ্জ উপজেলায় ঝাড়বাড়ী ও মরিচা ইউনিয়নের মুরারীপুর গ্রামে পেঁয়াজ বীজ আবাদ হয়েছে ২২৫ হেক্টর জমিতে।
ঝাড়বাড়ী গ্রামের কৃষক রমিজ উদ্দিন জানান, তাদের ওই দুটি গ্রামে উৎপাদিত পেঁয়াজের বীজের বাজার মূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা। ওই দু’টি গ্রামে যারা দিনমজুরি করেন, তারাও জমি বন্ধক নিয়ে কমপক্ষে ৩৩ শতক জমিতে এবারে পেঁয়াজ বীজের আবাদ করছেন।
বীরগঞ্জ উপজেলার ঝাড়বাড়ী গ্রামের চাষিদের দেখে পেয়াঁজ বীজ চাষে আগ্রহ বেড়েছে সমগ্র উপজেলার কৃষকদের। উপজেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি মৌসুমে শুধু ঝাড়বাড়ি ইউনিয়নেই সুলতানপুর, দেবীপুর ও ঝারবাড়ী গ্রামের ৩টি বøকে ২৫০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ বীজের আবাদ হয়েছে। এসব ক্ষেতে উৎপাদিত বীজের বাজার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। বীরগঞ্জের পুরো উপজেলার ১২ ইউনিয়নে পেঁয়াজের বীজ আবাদ হয়েছে ৫১০ হেক্টরে জমিতে। যার বাজার মূল্য প্রায় ১২০ কোটি টাকার মতো।
চাষিরা জানান, কিং, কুইন, তাহেরপুরী ও সুখসাগর পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে এই এলাকার মাটি উপযোগী। চলতি বছর এর আবাদে প্রতি ৩৩ শতকের বিঘায় লাগছে ৫০ হাজার থেকে ৬৫ হাজার টাকা। এবার বিঘায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। গত বছর প্রতি কেজি বীজ বিক্রি হয়েছিল এক হাজার ৭০০ টাকায়। এবার প্রতি কেজি কমপক্ষে ২ হাজার টাকায় বিক্রির প্রত্যাশা করছেন চাষিরা।
উপজেলার ঝারবাড়ি, মরিচা ও মোহনপুর এই ৩টি ইউনিয়নসহ এই উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের সব গ্রামের মাঠ এখন পেঁয়াজের সাদা ফুলে ছেয়ে গেছে। সেই ফুলে হাতের ছোঁয়ায় কৃত্রিম পরাগায়ন করছেন চাষিরা। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত পরাগায়ন করতে হয় পেঁয়াজ ফুলের। বিকেলে চলে সেচের কাজ।
বীরগঞ্জের দেবীপুর গ্রামের আমজাদ আলী গত বছর ৫বিঘা জমিতে পেঁয়াজ বীজের আবাদ করেছিলেন। এবার করেছেন ৮ বিঘা জমিতে। ফাল্গুনের শুরুতেই ক্ষেতে কৃত্রিম পরাগায়ন শুরু করেছেন। তিনি জানান, পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করে দেবীপুর ও ঝাড়বাড়ি গ্রামের কমপক্ষে ৫০ জন কৃষক আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। অভাব-অনটন থেকে মুক্তি পেয়েছে এই দুটি গ্রামের মানুষ।
উপজেলার ধুকুরঝাড়ী গ্রামের মহেশ পাল জানান, কয়েক বছর ধরে তিনি পেঁয়াজ বীজের আবাদ করছেন। পরিবারের সবাই মিলে কাজ করেন ক্ষেতে। তাই শ্রমিক লাগে না। গত বছরের মুনাফা দিয়ে পাকা বাড়ি তুলেছেন। এ বছর সেই বাড়ি প্লাস্টার, চারপাশের সীমানা প্রাচীর দেবেন। এছাড়া তার দুই ছেলের নতুন করে বাড়ি করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন।
বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ হাটের মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, ইজিবাইকসহ নানা যানবাহনের যন্ত্রাংশের ব্যবসা আছে শহিদুলের। ব্যবসা বন্ধ রেখে চলতি বছর প্রায় ৯ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ বীজ আবাদ করেছেন। তিনি জানান, ব্যবসা বন্ধ রেখে দিনমজুরদের নিয়ে সাড়ে ৪ মাস ধরে তিনি নিজেই মাঠে কাজ করছেন।
শহিদুলের মতো অনেকেই ব্যবসা বা চাকরির চেষ্টা ছেড়ে মনোযোগ দিয়েছেন পেঁয়াজের বীজ আবাদে। বেকারত্ব ঘুচেছে অনেক যুবকের।
চাকরি না পেয়ে ২ বছর আগে কৃষিকাজে নেমেছেন মুররীপুর গ্রামের সোহেল রানা। এবার পেঁয়াজ বীজের আবাদ করেছেন ৬ বিঘা জমিতে। তিনি জানান, ৪ মাস পরিশ্রম করে পেঁয়াজ বীজটা বিক্রি করতে পারলেই কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা লাভ হবে। চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেই উদ্যোক্তা হয়েছেন। প্রতিদিন তার ক্ষেতে কাজ করছেন ১০ জন শ্রমিক।
তিনি বলেন, এলাকার তরুণরা এখন উদ্যোক্তা হিসেবে পেঁয়াজ বীজ আবাদ, সংরক্ষণ ও বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জন করছেন। এবারে পেঁয়াজের বীজ চাষে তরুণ কৃষকদের তারুণ্যের উৎসব শুরু হয়ে গেছে।
বীরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, উপজেলার কয়েকটি গ্রামের চাষিদের দেখে জেলার এই উপজেলায় পেঁয়াজ চাষ কয়েকগুণ বেড়েছে। এটা ঝাড়বাড়ী গ্রামের চাষিদের বড় অর্জন। আমরা কৃষকদের পাশে থেকে নানাভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা করছি।
তিনি বলেন, আবহাওয়া অনুক‚লে থাকলে প্রায় শত কোটি টাকার পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করতে পারবেন বীরগঞ্জ উপজেলার চাষিরা।
জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুজ্জান মিয়া জানান, তিনি নিজে গত দু’দিন বীরগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি গ্রামে সফল পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের চিত্র সরজমিনে দেখে এসেছেন। তিনি এই সফলতা থেকে অভিভূত হয়েছেন। আগামীতে সমগ্র জেলায় এ ধরনের পেঁয়াজের চাষ ও বিক্রির কার্যক্রম এগিয়ে নিয়া যাওয়ার জন্য মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।