দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া ৩ হাজার সাওতাল ও তুরী পরিবার আজ ঘুরে দাড়িয়েছে। হয়েছে স্বাবলম্বী। নবাবগঞ্জ উপজেলার আদিবাসীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন এবং আর্থিকভাবেও সচ্ছল।
ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে ৩১৫টি সাওতাল ও তুরী পরিবারের পাশাপাশি ৩ হাজার প্রান্তিক পরিবারের জীবনমান উন্নয়ন, আয় বৃদ্ধি, দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাসটেইনেবল লাইভলিহুডস ডেভেলপমেন্ট অব দ্য এক্সট্রিম পুওর কমিউনিটিজ (সাপোর্ট) প্রকল্পের মাধ্যমে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
সরেজমিন দেয়া যায়, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১২১টি নারীভিত্তিক স্বনির্ভর গ্রæপ গঠন করা হয়েছে, যারা নিয়মিত সঞ্চয় করছে, নিজেদের মধ্যে থেকে সুদবিহীন ঋণ নিচ্ছে এবং নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মুষ্টিচালভিত্তিক খাদ্য ব্যাংক পরিচালনা করছে। পরিবারগুলোর সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে আয়বর্ধক কর্মকাÐের জন্য নগদ অর্থ, প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা। প্রকল্প কর্কান্ডের স্থায়িত্বশীলতার লক্ষ্যে গঠিত এপেক্স বডি উত্তরণ মহিলা সমবায় সমিতি ইতোমধ্যে সরকারি সমবায় দপ্তর থেকে নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয়েছে এবং দলগত ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই উদ্যোগ প্রকল্প-পরবর্তী সময়েও দলগুলোকে স্বনির্ভরভাবে পরিচালনার ভিত্তি তৈরি করবে।
প্রকল্প ব্যবস্থাপক কাজল কুমার বসাক বলেন,দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় এই প্রকল্প দরিদ্র মানুষের জন্য শুধু আয় বৃদ্ধির পথ নয়, বরং সম্মিলিতভাবে সংগঠিত হওয়ার, অধিকার আদায়ের এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। প্রান্তিক নারীরা আজ নেতৃত্ব দিচ্ছে, অধিকার নিয়ে কথা বলছে, নিজেদের অর্থনৈতিক কর্মকাÐ পরিচালনা করছে, এটাই প্রকৃত পরিবর্তনের সূচক। আমরা চাই, এই পরিবর্তন হোক টেকসই ও স্থায়ী।
সংস্থার অ্যাডভোকেসি ও যোগাযোগ সমন্বয়কারী সফিউল আযম বলেন, যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশে ১৯৯১ সাল থেকে কাজ করছে। প্রান্তিক মানুষের উন্নয়ন,মর্যাদাও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ইসলামিক রিলিফ সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা চাই শ্রেণি বর্ন নির্বিশেষে সবাই সমানমর্যাদালাভ করুক এবং জীবনমান উন্নয়ন হোক। সে লক্ষ্যেই এই সাপোর্ট প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে নবাবগঞ্জে।
জানা গেছে, এই প্রকল্পের আওতায় সকল উপকারভোগীকে নেতৃত্ব উন্নয়ন নারী ও পুরুষকে অধিকার, মানবাধিকার ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গবাদিপশু পালন, ছাগল পালন, হাঁস-মুরগি পালন ও গরু মোটাতাজাকরণ বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যার ফলে তারা এখন স্বাবলম্বী ও আত্মবিশ্বাসী।
নবাবগঞ্জ উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের সাওতাল সনমনি কিসলু স্বামী মারা যাওয়ায় দুই সন্তান নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন। তাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়, ঠিকমত খাবার দিতে পারছিলেন না। তিনি বলেন, ইসলামিক রিলিফ থেকে আমি গরু ও ছাগল মোটাতাজাকরণ, হাঁসমুরগি পালন ও সবজি চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি এবং এসবের জন্য এককালীন ২০ হাজার টাকা পাই। যা দিয়ে আমি একটি গরু কিনি। এখন আমার তিনটি গরু, ৫টি ছাগল এবং অনেকগুলো হাস মুরগি রয়েছে। যা থেকে আমার সংসার ভালভাবে চলে এবং ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। আমি এখন স্বাবলম্বী।
দিনমজুরের কাজ করা একই গ্রামের আরতি কিসলু বলেন,সাওতালরা ব্যবসা করতে ভয় পায়, সবাই ভাবে দোকান দিলে টিকবে না। কিন্তু ইসলামিক রিলিফ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে আমি সেই ভয় কাটিয়ে মুদি দোকান দিয়েছি এবং ভালো আয় করছি।তিনি আরও বলেন, ব্যবসার পাশাপাশি আমি পাড়ার মানুষের বিভিন্ন সমস্যায় পাশে থাকি, সরকারি সেবা নিতে সহায়তা করি, কোথাও নারী নির্যাতন হলে প্রতিবাদ করি।
একজন দলনেত্রী বিলকিস খাতুন বলেন,আগে আমরা জানতাম না ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হটলাইন সেবাগুলো সম্পর্কে। ইসলামিক রিলিফ আমাদের নেতৃত্ব ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলেছে। তিনি আরো বলেন, আগে মানুষের কাছে হাত পাতলে অপমান করত, এখন সম্মান করে, কথা বলার সুযোগ দেয়, এই দলের কারনে এখন আমরা অনেক শক্তিশালী।
আমরা খুব গরিব ছিলাম, সন্তানের মুখে তিনবেলা খাবার দিতে পারতাম না। কারো কাছে সাহায্য চাইলেও তাড়িয়ে দিত। ইসলামিক রিলিফ আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করে। এককালীন ২০ হাজার টাকা ও প্রশিক্ষণ পেয়ে এখন নিজেকে অন্যভাবে খুঁজে পেয়েছি। আমার এখন অনেকগুলো হাঁস, মুরগি, গরু ও ছাগল এবং সবজি বাগান রয়েছে। এখন সন্তানের মুখে হাসি ফুটাতে পারছি- এভাবেই অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিলেন হিরচাঁদ গ্রামের শ্রীমতি শেফালী বালা।
রঘুনাথপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী আফরিন নাহার নিপা বলেন, আমাদের মতো প্রত্যন্তবিদ্যালয়ে ইসলামিকরিলিফ সেনিটারি ভেন্ডিং মেশিন সুবিধাদিয়েছে, যা আমার বিদ্যালেয়ের ছাত্রীদেরজন্য অনেক উপকার হয়েছে। আগে আমরা যারা বয়সন্ধিকালীন পিরিয়ডের জন্য বিদ্যালয়ে আসতাম না ভয়ে, এখন আমাদের সেই ভয় কেটে গেছে। তিনি আরো বলেন, ইসলামিক রিলিফ আমাদের কিশোরীদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিচ্ছন্নতা এবং অধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে, ফলে আমরা বাল্যবিয়ে এবং ইটিজিং বিষয়ে সোচ্চার।
নবাবগঞ্জ উপজেলার বিনোদনগরইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ইসলামিক রিলিফ আমাদের এলাকায় যে কর্মকান্ড পরিচালনা করছে, তার সাথে আমরা শুরু থেকেই জড়িত। প্রান্তিক মানুষদের খাদের কিনার থেকে তুলে এনে স্বাবলম্বী করার যে প্রক্রিয়া, তা নি:সন্দেহে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ।তিনি আরো বলেন, এনজিও’র কাযক্রমে এমন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অনন্য দৃষ্টান্ত বিরল,এই মডেলটি অনুসরণ করার জন্য আমি অন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোকে অনুরোধ করছি।
নবাবগঞ্জে ৩ হাজার পরিবারকে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি জলবায়ু সহনশীল কৃষি ও পশুপালনের কৌশল, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য ও সচেতনতা কার্যক্রম, স্কুলভিত্তিক স্বাস্থ্যবিধি সচেতনতা, কিশোরীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন স্থাপন এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হুইল চেয়ারসহ অন্যান্য উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে প্রকল্পটি একটি সামগ্রিক উন্নয়ন মডেল হিসেবে কাজ করছে।