মোঃ মোবারক আলী,রাণীশংকৈল (ঠাকুরগাঁও) থেকেঃ জায়গা জমির সমস্যা, পাওনা টাকা আদায়, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ মিটানোসহ ধর্ষনের মতো জঘন্যতম অপরাধের ঘটনা বিচার শালিসের মাধ্যমে সমাধান করে। ঠাকুরগাঁও রাণীশংকৈল থানা এখন বিচারালয়ে পরিণত হয়েছে। তবে এমন বিচার শালিসের কারণে বেড়ে গেছে দালালদের দৌরাত্ব। এতে সমাজের বড় অপরাধের অপরাধীও পার পেয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি থানা পুলিশের বিচার নিয়ে অনুসন্ধানে নামে এ প্রতিবেদক এতে কথা হয় বিয়ের নামে প্রতারণা করে দীর্ঘ এক বছর ধরে ধর্ষণের স্বীকার উপজেলার পদমপুর গ্রামের বুলু’র কন্যা স্মৃতির সাথে (২৪) তিনি জানান, মিথ্যা ভালবাসার অভিনয় দেখিয়ে তার প্রথম সংসার থেকে তাকে বিচ্ছেদ করিয়ে তাকে বিয়ের নামে নাটক করে র্দীঘ এক বছর তাকে নিয়ে ঢাকায় সংসার করেছেন নেকমরদ বিলপাহাড় গ্রামের গোলাম রুসুলের ছেলে হুমায়ুন কবির।
তবে অজ্ঞাত কারণেই সম্প্রতি হুমায়ন তার বাড়ীতে না নিয়ে রাণীশংকৈলে নিয়ে এসে পৌর শহরের রংপুরিয়া মার্কেটে ভাড়া বাসায় তোলেন স্মৃতিকে। তবে ভাড়া বাসায় তুললেও প্রায় যোগাযোগ বন্ধ করে দেন হুময়ান। এ নিয়ে প্রতিবাদ করায় স্মৃতিকে স্বামীসহ তার পরিবারের লোকজন বেদড়ক মারপিট করে। পরে স্থানীয়রা উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। এ ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ দিলে এ এস আই বুলু মিয়া তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ হন। অভিযোগ রয়েছে এ এস আই বুলু মিয়া স্মৃতিকে আইনি কোন সহযোগিতা না করে উল্টো উৎকোচের বিনিময়ে তার স্বামী হুমায়নের পক্ষ নিয়ে বিষয়টিকে ধামা চাপা দেন। স্মৃতি বলেন, মিথ্যা বিয়ের নাটক সাজিয়ে আমাকে ধর্ষণ করেছে আমার এমন অভিযোগ থাকলেও বিয়ের উপযুক্ত কাগজ আমি দেখাতে না পারায় এ এস আই বুলু আমাকে বলে আপনার বিয়ের কাগজ নেই। তাই আপনি ওর (হুমায়ন) কিছু করতে পারবেন না। তার থেকে বিচার করে দিচ্ছি। সেই বিচারে হুমায়নকে পঞ্চান্ন হাজার টাকা অর্থদন্ড করে আমার পরিবারের হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে বিচার শেষ করেন। পরে আবার পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে দালাল আর পুলিশকে দিতে চলে যায় প্রায় ২০হাজার টাকা। হাতে থাকে মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা। স্মৃতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি চাইলাম ধর্ষণের বিচার তা না করে আমাকে বিচারের মাধ্যমে টাকা ধরিয়ে দিয়ে আমার জীবনটাকে শেষ করে দিল।
একইভাবে গত ১৫অক্টোবর সন্ধায় উপজেলার রাউতনগর চড়োলপাড়ার আবুল কালামের অষ্টম শ্রেণীর পড়ুয়া মেয়েকে বাড়ীর লোকজনের অনুপস্থিতিতে জোর পূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা চালায় পার্শ¦বর্তী হরিপুর উপজেলার যাদুরানী বাজার এলাকার শুকুর আলীর ছেলে মাসুদ রানা(২০)। ধষর্ণের চেষ্টাকালে মেয়েটির চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে তারা ধর্ষককে আটক করে থানায় খবর দেয়। থানা পুলিশের এ এস আই বুলু মিয়া ঐ দিন মধ্যেরাতে ছেলেটিকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করে নিয়ে এসে থানার মধ্যে রেখে পরের দিন বিচার শালিসের মাধ্যমে ৮০ হাজার টাকা অর্থদন্ড করে। বিশ হাজার টাকা নিজের জন্য রেখে বাকী টাকা বাদীর হাতে তুলে দেয় এ এস আই বুলু মিয়া এ ঘটনার তথ্য নিশ্চিত করেন বাদী-বিবাদীর পিতা মাতা। এমন অভিযোগ স্বয়ং ওসি(তদন্ত) এ এস আই,এস আইদের বিরুদ্ধেও রয়েছে।
এদিকে থানায় লিখিত অভিযোগ দিলেই তদন্ত কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে তদন্তে যেতে তেল খরচ বাবদ নগদ ১ হাজার ৫শ থেকে ২ হাজার টাকা অগ্রীম বুঝে দিতে হয়। অভিযোগটি নিয়ে থানার তদন্ত কর্মকর্তা মফস্বল এলাকায় গিয়ে বিবাদীকে চরম আইনি ক্ষমতা দেখান। কুলকিনারা না পেয়ে বিবাদী আবার ধরেন স্থানীয় মাতব্বর বা কতিপয় দালালদের। দালালরা পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেন। এবং অভিযোগটি নিয়ে সমাঝোতায় বসার ব্যবস্থা করতে বলেন। অভিযোগ রয়েছে যে কোন অপরাধমুলক ঘটনার বাদী-বিবাদীরা নিজেদের পক্ষে বিচারের রায় নেয়ার জন্য কতিপয় দালালদের মাধ্যমে হাজার হাজার টাকারও রফাদফা করেন। দালালরা আবার বিচার সংশ্লিষ্ট পুলিশ (পরির্দশক,উপ-পরিদর্শক,সহকারী উপ-পরিদর্শক) সদস্যের সাথে কথা বলে তা নিশ্চিত করেন। এ কারণেই থানায় জমে উঠেছে বিচার শালিসের নামে জমজমাট অর্থ বাণিজ্যে। তবে এমন বিচার শালিসের কারণে অপরাধীরা সাময়িক অর্থদন্ড দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে অনেকে মনে করেন ।
এদিকে থানায় প্রায় প্রতিদিনই বিচার শালিস করায় স্থানীয় ইউপি পরিষদের গ্রাম আদালতের কার্যক্রম ভেস্তে যেতে বসেছে। গ্রামাঞ্চলে সংঘটিত মামুলী অপরাধ সমূহের বিচার সহজভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্পাদনের উদ্যেশে ১৯৭৬ সালে গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ জারী করে সরকার। কিন্তু সে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মামুলী অপরাধসহ যে কোন ঘটনার বিচার সালিশ করছে থানা পুলিশ। আর এ সুযোগেই সাধারণ মানুষ গ্রাম আদালতে না গিয়ে দালালদের পরামর্শে যে কোন ঘটনায় থানা মুখি হওয়া শুরু করেছেন।
ঠাকুরগাঁও আইনজীবি সমিতির সাবেক সম্পাদক এ্যাডভোকেট শেখ ফরিদ বলেন, বিচার শালিস করার পুলিশের এখতিয়ার নেই তবে তারা ঘটনার আলোকে অভিযোগ মুলে ঘটনা স্থলে গিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নিবে এটাই তাদের কাজ। তিনি আরো জনান, থানা পুলিশ দ্রতব্য অপরাধে এজাহার বা অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রাথমিক সত্যতা নিরুপণ করে। মামলাটি বিচারের জন্য আদালতে প্রেরণ করতে পারে। তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন,ধর্ষণের মত ঘটনাতো আদালত সমাধান দেওয়ার এখতিয়ার রাখে না সেখানে পুলিশ কিভাবে সমাধান দেয়।
বাচোর ইউপি চেয়ারম্যান জিতেন্দ্রনার্থ বর্ম্মন সহ একাধিক ইউপি সদস্য বলেন, পুলিশ যেভাবে সব ঘটনা আমলে নিয়ে বিচার শালিস করছে। তাতে আমরা স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বাররা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। পুলিশের এমন বিচার শালিস করে গ্রাম আদালতকে অবমাননা ও স্থানীয় বিচার ব্যবস্থাকে ভেস্তে দিচ্ছে বলে দাবী করেন তারা।
জানতে চাইলে এ এস আই বুলু মিয়া মুঠোফোনে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য না করে বলেন, আমি রংপুর আছি এখান থেকে এসে আপনার সাথে বসে বিষয়গুলো সমাধান করবো।
থানা পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল লতিফ সেখ বলেন, ছোট খাটো সমস্যাগুলি স্থানীয় মাতব্বর অথবা ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বারদের উপস্থিতিতে গ্রাম আদালতের অংশ হিসাবে সালিশ করে থাকি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এএসআই বুলুর বিষয়টি আমি শুনেছি সে থানায় এলে আপনাকে নিয়ে সমাধান করা হবে।
রাণীশংকৈল সার্কেল এএসপি তোফাজ্জল হোসেন বলেন,থানায় বিচার শালিস করার কোন এখতিয়ার নেই । এ বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। তবে যেহেতু আপনি বললেন বিষয়টি আমি দেখবো।