আনোয়ার হোসেন আকাশ,
রাণীশংকৈল (ঠাকুরগাঁও)প্রতিনিধি:
ঠাকুরগাওয়ের রাণীশংকৈল পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে ৩ ডিসেম্বর’৭১ মুক্ত হয়। সেই সাথে একই দিনে মুক্ত হয় হরিপুর পীরগঞ্জ বালিয়াডাঙ্গীসহ ঠাকুরগাও জেলা । পাক স্বৈরশ্বাসক গোষ্ঠির দাবানল থেকে মুক্তি পেতে বাঙালী ছাত্র-জনতা দাবি আদায়ের আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে।
উপজেলার খুনিয়াদিঘি এক হৃদয় বিদারক নাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক বাহিনীর বর্বরতার স্বাক্ষর বহন করে আসছে এটি। লোমহর্ষক কাহিনীর মাইল ফলক হিসেবেও ধরা হয় এ নামটিকে।
পাক হানাদার বাহিনী বাঙালী জাতিকে নায্য দাবি থেকে বঞ্চিত রাখার জন্য অমানবিকভাবে হত্যা জুলুম, নির্যাতন শুরু করে। উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে স্বাধীনতাকামী মানুষদের ধরে এনে দুই চার দিন অনাহারে থানায় আটকে রাখত পাক বাহিনী। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটপট করতে থাকা নিরীহ বাঙালীদের রাতের বেলা খুনিয়া দিঘিতে ধরে এনে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে নির্বিচারে মেরে ফেলতো। ভাগ্যে জুটতো কাফন দাফন কবর। গর্ত করে একই গর্তে কয়েক জনের লাশ ফেলে মাটি চাপা দিয়ে দিত। তাছাড়া হাজার হাজার লাশ পুকুরের পানিতে ফেলে রাখতো। দিনে জমে উঠতো শকুনের লাশ খাওয়ার মেলা আর রাতের বেলা শিয়ালের ভিড় জমতো। খুনিয়া দিঘির পুকুরের পানি সব সময় রক্তে রঙ্গিন লাল হয়ে থাকত। দুর্গন্ধে এলাকায় মানুষ থাকতে পারতো না। লোমহর্ষক কাহিনী বাঙালীকে ভয়াবহ এক ট্রাজেডীতে রূপান্তরিত করেছিল। বেশীদিন আর টিকে থাকতে পারেনি হানাদার বাহিনী। বাঙালী বীর সন্তানদের প্রতিরোধের মুখে পাক হানাদার বাহিনী এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। ৩ ডিসেম্বর মুক্ত হয় রাণীশংকৈল উপজেলা।
হত্যা, জুলুম নির্যাতন নিপিড়নকে পদ দলিত করে বাঙালীর অর্জিত লাল সবুজের পতাকা থানায় উত্তোলন করে রাণীশংকৈল কে মুক্ত ঘোষনা করেন ভান্ডারা গ্রামের মফিজউদ্দিনের ছেলে যুদ্ধ কালীন কমান্ডার মোঃ সিরাজুল
ঠাকুরগাঁও ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। ফলে দিসবটিকে হানাদার বাহিনী মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে এলাকার যুবক, বৃদ্ধসহ নানা বয়সের মানুষ।
পাক সেনাদের পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয় নিয়ে রাণীশংকৈলের প্রাণ পুরুষ আলী আকবর এমপি, ইমরান আলী চেয়ারম্যানসহ স্থাণীয় কিছু লোকের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প চালু করা হয় রাণীশংকৈল ডাক বাংলোতে। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন আবু সুফিয়ান। যোদ্ধারা উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যায়। উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে তারা বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। খবর পেয়ে পাক সেনারা ৭১ সালের ১৯ এপ্রিল ঠাকুরগাও থেকে রাণীশংকৈলে প্রবেশ করে।
সেদিন হত্যা করে রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রামের নজরুল ইসলাম, সহোদর গ্রামের নফিজ আলী মাষ্টারসহ ছাত্রনেতা মুনসুর আলী, মহেন চন্দ্র, কুরবান আলীসহ অনেককে। প্রাপ্ত তথ্যমতে নফিজ আলী মাষ্টারসহ কয়েকজনের লাশ আজো পাওয়া যায়নি।
পার্শ্ববর্তী উপজেলা পীরগঞ্জ ক্যাম্প থেকে এসে পাক সেনারা ১লা মে মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানকে সিংপাড়া সংলগ্ন নদীর ঘাটে গুলি করে আহত অবস্থায় তাকে আটক করে রংপুর কারাগারে আটকে রাখে পাক সেনারা। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে রাণীশংকৈল থানায় স্থাণীয়ভাবে ক্যাম্প চালু করে তারা।
তখন থেকেই বাংলা মায়ের সন্তানদের উপর নির্বিচারে জুলুম, নিপিড়ন, নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুটপাট চালায় হায়েনার দল। এদেশের কিছু দেশদ্রোহী লোক সহযোগীতা করে পাক সেনাদের। তারা নিজে লাভবান হওয়ার জন্য অবিচার করেছে সেদিন এ জাতির উপর, মা-মাটির উপর। যাদের আজো জাতি ক্ষমা করতে পারেনি, পারছেনা। এলকার মানুষকে ধরে এনে অনাহারে দু-চার দিন তাদের ক্যাম্পে আটকে রাখার পর খুনিয়া দিঘিতে আনত। চোখ বেঁধে সারিবদ্ধ করে চালাত নির্বিচারে গুলি।
ফেলে দেয়া হতো খুনিয়াদিঘির পানিতে। পাক সেনারা যতদিন এখানে এ নির্মমতা চালিয়েছে ততদিন ভর পুকুরের পানি লাল রঙে রঙিয়ে থাকতো। দেয়া হতো অনেক বাঙ্গালীকে মৃত আধামৃত অথবা জীবিতদেরকে দেয়া হতো এই বদ্ধ ভূমিতে কবর।
ভান্ডারা গ্রামের মৃত আনসারুল মজিরউদ্দিনের ছেলে যুদ্ধকালিন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রথমে রাণীশংকৈল ডাক বাংলোতে আবু সুফিয়ানের কাছে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। পরে ভারতে উন্নত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। হানাদার বাহিনী মুক্ত করে ৩ ডিসেম্বর আমি বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা উত্তোলন করি।
খুনিয়াদিঘি গণকবরের স্বাক্ষরতা বহন করলেও এই বদ্ধ ভূমির কোন মর্যাদা রাখা হয়নি। এদেশের শহীদ সন্তানদের কবরের উপর অবাধে চলে নেশার আসর সহ নানা অপকর্ম। উপজেলা চত্বর থেকে আধা কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত খুনিয়াদিঘি।
অযত্নে অবহেলায় থাকার কারনে মাদক সেবীরা স্মৃতিসৌধ প্রাচীরের লোহার পাতি খুলে নিয়ে পালাচ্ছে। এটির প্রতি গুরুত্ব দেয়ার জন্য আকুল আহবান জানিয়েছেন এলাকার স্বাধীনতা পক্ষের মানুষ।