আসাদুজ্জামান ।। বাঙলা, বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাস অনেক বড় এবং সমৃদ্ধ। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের জন্ম একজন বাঙালী হিসেবে যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। পৃথিবীতে অনেক জাতি গোষ্ঠী যেমন কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে, আবার অনেক জাতি গোষ্ঠীকে ভৌগলিক সীমার রূপ দিতে তেমন ত্যাগ তিতীক্ষা বা আন্দোলন সংগ্রাম এবং রক্তপাত ঝড়াতে হয়নি।
বাঙালী জাতি গোষ্ঠীর জন্ম সিংহোলের ভেড্ডারা এবং মঙ্গলীয় সম্প্রদায় থেকে। বাংলার বয়স আজ ১০৭০ বছর অথ্যাৎ বাংলা ভাষার জন্ম ৯৫০ খ্রিস্টাব্দে। এ দীর্ঘ পথ বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম, জুলুম, নির্যাতন এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন দানের বিনিময়ে আজকের বাংলাদেশ। সমসাময়িক বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকালে বৃট্রিশ বিরোধী আন্দোলন, ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের বিভক্তি, ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ তে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ তে ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এ গণআন্দোলন, ১৯৭০ এ জাতীয় নির্বাচন এবং সর্বশেষ বাংলা ভাষা বাঙালী জাতীর ১০২০ বছরের জুলুম নির্যাতনের সেই সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে একটা নিজস্ব ভৌগলিক সীমা, একটা মানচিত্র, একটা পতাকা অর্জিত হয়েছে। যত সহজে এবং যত স্বল্প সময়ে আমরা বাঙালী জাতির আন্দোলন সংগ্রামের কথা বলছি বিষয় গুলি কি এতো ক্ষনিকের? না তা নয়। দীর্ঘ এ পথ পরিসীমায় অজ¯্র মানুষের যে ত্যাগ এ সময়ে স্বাধীন এ দেশে বসে তার মূল্যায়ন কতটুকুই বা হচ্ছে? বৃট্রিশ বিরোধী আন্দোলনে খুদিরামের আত্ম ত্যাগ, প্রীতিলতা, সুবাশ বোস সহ অজ¯্র বাঙালী তাদের সর্বস্য বিলিয়ে দিয়েছিল বাংলার জন্য। হাজার হাজার বছরের জন্য “মুক্তিযুদ্ধ” শিল্প সাহিত্য সাংস্কৃতিতে বড় উপজিব্য হিসেবে কাজ করে যাবে নিশ্চই। বাংলা জাতির চুড়ান্ত রুপ ছিল মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধকে উপজিব্য করে তৈরি হয়েছে অনেক গল্প, নাটক, উপন্যাস এবং সিনেমা প্রভৃতি। তুলে নিয়ে আসার চেষ্টা হয়েছে সে সময়ে বিভিন্ন বিষয় বস্তু। মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা হারিয়ে গেছে সময়ে না ধরতে পারার জন্য। অজস্য মানুষের এ বাংলার জন্য নিজেদের উৎস্বর্গের বিষয়গলো তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। নতুন প্রজন্মের কাজে মুক্তিযুদ্ধ সেভাবে টানে না। জাতির বীরদের না দিয়েছি সম্মান, না যথাযোগ্য মর্যাদা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে যা মনে হচ্ছে তা দাড়াচ্ছে এরুপ যে ঘরে বসে কতগুলো চুক্তির মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা নির্ধারিত হয়েছে। সেই চুক্তিতে ধর্ম ব্যবসায়ীদের একটা অংশীদারিত্ব ছিলো। কে বুঝাবে এই সাম্প্রদায়িক ধর্মাশ্রিত গলাবাজদের যে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বর্ষ বিভক্ত হয়েছিল। ২৪ বছর পাকিস্তান ধর্মের নামে কি ভাবে তাদের এপারের জাত ভাইদের শাসন শোষন জুলুম নির্যাতন করেছিল। বুকপিঠ ঠেকে যাওয়া বাঙালী জাতি গোষ্ঠী ধর্মের নামে শাসন পরিত্যাগ করে ধর্ম নিরেপক্ষতার ভিত্তিতে সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে এ দেশটাকে স্বাধীন করেছিল। দেশ সেই ভাবেই চলছে এবং সব দিক দিয়েই এখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের যে, অনেক এগিয়ে। ধর্ম নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে স্বাধীন হওয়া এ ভূখন্ডে ধর্ম ব্যাবসায়ীদের বাঙালী সংস্কৃতিতে আঘাত করার যে হুংকার তা সত্যি বড়ই দূভাগ্যের। একটি রাষ্ট্রের পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের ধারায় সামীল করার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোটা প্রথা চলে এসেছে। যেখানে এ রাষ্ট্র বির্নিমানে যে সব অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ নিজের জীবন বাজী রেখে স্বাধীনতার জন্য নিজেকে উৎস্বর্গ করেছিলেন। দূর্ভাগ্য হলেও সত্য দেশের সামাজিক উন্নয়নে তারাই আজ পিছিয়ে। সরকার সেটা উপলদ্ধি করে উন্নয়নের ধারায় সামীল করার জন্য তাঁদের সন্তানদের জন্য চাকুরিতে কোটা প্রর্বতন করেছিলেন। সেটাতে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। আন্দোলন করে সেটা বাতিল করা হয়েছে। দুঃখ লাগে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যখন সরকার মাত্র ১০ হাজার টাকা ভাতা প্রদান করে তখন এ দেশেরে এক শ্রেণীর মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের কেন এতো টাকা দেওয়া হবে বলে বাসে মোটরে সমালোচনার ঝড় তোলেন। একবারও মনে হলোনা সেই সমালোচকদের, দেশটা যদি স্বাধীন না হতো তাহলে সরকারি কর্তার ১ লক্ষ টাকা বেতন, গাড়ী ঘোড়া, বড় বড় বিল্ডিং, ব্রীজ কালভার্ট, পোষাক-আসাক, দেশ-বিদেশ ঘুরা এবং এখনকার এই উন্নত জীবন কখনই সম্ভব ছিলনা। আর যাঁরা এ স্বাধীনতার জন্য জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত গুলির নিশানায় থেকে যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন করেছেন তাঁদের বিষয়ে আমাদের কতটা যতœশীল, শ্রদ্ধাশীল এবং কতটা সম্মান জানানো উচিত বিবেককে প্রশ্ন করে দেখবেন কী ? আমাদের স্বাধীনতা হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া বিষয় নয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা। আমাদের কখনই ভুলে গেলে চলবে না যে, অনেক সংখ্যক মানুষের জীবন দান রয়েছে এ ভূখন্ডের জন্য । বিশেষ করে আমাদের গর্বের, অংহকারের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। যা আমাদের আত্ম পরিচয় এনে দিয়েছে। শিখিয়েছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। সেই গৌরবের মুক্তিযুদ্ধে যারা সর্বস্য দিয়েছেন, হারিয়েছেন প্রিয়জনদের তাদের কখনই অমর্যাদা করা জাতির জন্য সুভকর হবে না। মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে ২ লক্ষ মা বোনদের ইজ্জত এবং ৩০ লক্ষ শহীদ একটা জাতির জন্য এই ক্ষত বিরাট। এখনো এই বিরাট ক্ষত চিহ্ন নিয়ে সেই পরিবার গুলির অনেক সদস্য বড় কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছেন। পাকিস্তান কখনই এই জাতিকে জাতি রাষ্ট্রে রুপ দিতে চায়নি এজন্য তারা সবকিছুই করেছে। এমনকি পরাজয় বুঝতে পেরে এ জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মম ভাবে হত্যা করে। যেন পরর্বতীতে সহজে উঠে দাঁড়াতে না পারে এ জাতি। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষনের পর থেকে মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার জাগরন তৈরি হয়, তা দমাতে ২৫শে মার্চ ৭১ ক্রেকডাউন দেয় ঢাকায় পাকিস্তান আর্মী। চলতে থাকে হত্যার হোলি খেলা । বেছে বেছে তারা সারা দেশে বুদ্ধিবীজীদের অথ্যাৎ যাঁরা জাতির বিবেক, যাঁরা দূঃসময়ে জাতিকে পথ দেখায় এই শ্রেণিটিকে নির্মুলের নকশা করে সে অনুযায়ী সারাদেশে ব্যাপক হত্যা নীলা চালায়। এমন কি স্বাধীনতার উষালগ্নে পরাজয় আসন্ন জেনে ১৪ই ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার, এ্যাডভোকেট সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শিল্পীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের ঘাতক দালালদের সহযোগিতায় রায়ের বাজার বধ্যভুমিতে নির্মম ভাবে হত্যা করে। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশটিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ নির্মম হত্যাযজ্ঞ দেখে অবাক হয়ে যায় বিশ্ববাসী। ভোলা জাতি হিসেবে বেশ খ্যাতি রয়েছে বাঙালী জাতির। বিশ্বাবাসী সে হত্যাযজ্ঞের কথা ভুলতে না পারলেও আমরা ভুলে গেছি দিব্যি। কখনই কেউ সেই পরিবার গুলোর দিকে তাকায়নি। অভিভাবকদের এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ সেই পরিবার গুলোকে তছনছ করে দিয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীগন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের শত দমন পীড়নেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সে সময় প্রতিষ্ঠা পাওয়া এ পরিবার গুলো স্বাধীন বাংলায় অযতœ অবহেলায় অনেকে হারিয়ে গেছে। অনেকে দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করতে গিয়ে হেরে গেছে। স্বামীহারা, পিতাহারা, ভাইহারা, মা-বোনহারা এই পরিবার গুলোকে একদিকে সামলাতে হয়েছে স্বজন হারানোর বেদনা অন্যদিকে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সংগ্রাম করতে হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য। শোক, অভাব-অনটন এবং হতাশায় বাবাদের উৎস্বর্গ করা স্বাধীন বাংলায় বাবাদের মত নিজেদেরকে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি বুদ্ধিজীবী পরিবারের সন্তানরা। ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রের উন্নয়ের সাথে নিজেদের উন্নয়ন ঘটাতে। প্রশ্ন জাগে কি অপরাধ ছিলো এই পরিবাগুলোর। কেউ দায়িত্ব নেয়নি স্বাধীনতার পর এই পরিবাগুলোর, না রাজনৈতিক ভাবে, না সামাজিক ভাবে, না রাষ্ট্রীয় ভাবে। এই রুপ অনেক উদাহরন দেওয়া যেতে পারে পৃথিবী জুড়ে যে, এসব পরিবারগুলোর রাষ্ট্র দায়িত্ব নিয়েছে।
রাষ্ট্র বির্নিমানে বুদ্ধিজীবী মহলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাষ্ট্র পরিচালনায় যাঁরা যান তাদের সঠিক ভাবে চলার জন্য বুদ্ধিজীবীগনের ভুমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ন। তাঁদের জাতির বিবেক বলা হয়। কোন রকম রাজনৈতিক আর্দশে উদ্বুদ্ধ না হয়ে নিরপেক্ষ ভাবে সমাজেকে, রাষ্ট্রকে আলোর পথ দেখায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীগন যে ভাবে রাজনৈতিকদের সহযোগিতা করেছেন এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছাত্র যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মোটিভেট করেছিলেন তাতে পার্কিস্তানের বুঝতে অসুবিধা হয়নি মুক্তিযুদ্ধের মাষ্টার মাইন্ড কারা। নেপথ্যে কারা, তরুন -ছাত্র যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরার উৎসাহ যোগাচ্ছে। সমাাজের, দেশের বিবেক বলে খ্যাত বুদ্ধিজীবীগন রাষ্ট্রের যে কোন দুঃসময়ে জাতিকে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে উত্তরনের পথ দেখান পৃথিবীর সকল সমাজে, সকল রাষ্ট্রে জাতির বিবেকের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীদের উপর পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হামলায় আমাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি তাদের মেধা-মনন, লেখনি এবং রাজপথে নেমে জানান দিয়েছিলেন। বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন পার্কিস্তানীদের – বাঙালীদের উপর জেল, জুলুম, নির্যাতন হত্যা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা, সেই সাথে বাঙালীদের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার কথাও নিয়ে আসেন। হাজার বছরে বাঙালীদের সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলার স্বাধীনতা। আর এই অর্জনে যাঁরা অমর হয়ে থাকবেন তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু, রাজনৈতিক দলগুলো, বীরমুক্তিযোদ্ধগন, ৩০ লক্ষ শহীদ, ২ লক্ষ মা-বোনদের ইজ্জত এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে অবদান তা কখনই কোন কিছুর বিনিময়ে পরিশোধ যোগ্য নয়। তাঁদের অবদান অপরিসীম ,সকল দল মতের উর্দ্ধে তারা বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমাদের সবার অনেক শ্রদ্ধার। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা সেই সাথে এই পরিবারগুলোর প্রতি রইল অনেক ভালোবাসা।
আসাদুজ্জামান
পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও
০১৭১২৯০৬৭৮৫