আপেল মাহমুদ, রুহিয়া(ঠাকুরগাঁও)সংবাদদাতাঃসবুজের জমিনে রক্তিম সূর্য খচিত মানচিত্রের এই দেশটির ৪৯ বছর পূর্তি উদযাপন করছি আমরা। আমাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন নেই। একটি বৈষম্যহীন মুক্তসমাজ গঠনের অব্যাহত আকাঙ্ক্ষার ফসল বাংলাদেশ। জাতি যখন মুক্তির ৫০ বছর পূর্তির অপেক্ষায় উন্মুখ, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসবে- রাষ্ট্র আদিবাসী জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কতটা সফল হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও সদরের রহিমানপুর পটুয়া এলাকায় ১৫ আদিবাসী (পাদান) পরিবার অন্যের জমিতে বসবাস করে আসছে প্রায় দুই যুগেরও অধিক সময়। বিভিন্ন এনজিও তাদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটাবে প্রলোভন দেখালেও আসেনি কোন সফলতা। উল্টো তাদের অবস্থার অবনতি ঘটেছে প্রকৃতিক সহ নানান কারণে।ধান ক্ষেতে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করে পরিবারের জন্য দুই-এক মাসের চাল মজুত করেন। বাকি সময় অন্যের কাজ করে অভাব- অনটনের সঙ্গে লড়াই করতে হয় প্রতিনিয়ত। তাদের অভাব-অনটনের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে এনজিও গুলো সহযোগিতার কথা বলে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলে। খাবারের সংস্থান করতেই তাদের হিমশিম অবস্থা। এ অবস্থায় ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো লেখাপড়ারও সুযোগ পায় না।
পটুয়া এলাকার কালু পানের ছেলে মোনা পাহান একজন বাউল শিল্পী। ছোট বড় গানের অনুষ্ঠানসহ জেলা পর্যায়ে অনেক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন। তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে মিরা পাহান ও ছেলে মেঘনাত পাহানকে নিয়ে বিভিন্ন মঞ্চে গান করে উপার্জিত অর্থে ভালোই চলছিল মোনার সংসার।
প্রকৃতির অভিশাপ করোনা ভাইরাসের কারণে গানের অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেকার হয়ে পরেছে শিল্পী মোনা পাহান। তাই সংসারে অভাবের কারণে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করে ছয় সদস্যের বাউল শিল্পীর পরিবারটি জীবিকা নির্বাহ করছে।
মোনা পাহান জানান, আগে বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের নিয়ে গান করতাম, উপার্জন ভাল ছিল। এ অর্থ দিয়েই ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ মিটিয়ে ভালোভাবেই চলছিল সংসার। কিন্তু করোনার কারণে এখন গানের জন্য ডাক আসে না। তাই সংসার চালাতে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ আর মাঠে কাজ করেন। ছেলেমেয়েদেরও মাঠের কাজে লাগানো হয়েছে। এ অবস্থায় তাদের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটছে।
মোনা পাহান আরও বলেন, সংসারে অভাব ঘোচাতে এনজিও থেকে পশু পালনের জন্য আমরা অনেকেই ঋণ নিয়ে এখন বিপদে পড়েছি। এখন তাদের সুদ দিতে হচ্ছে। সুবিধা দেওয়ার কথা বলে এনজিও গুলো আসলে আমাদের ক্ষতিই করছে।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রায়পুর এলাকায় সোমবার দুপুরে দেখা হয় একদল উপজাতি সাওতাল ধানক্ষেতে শাবল দিয়ে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ছেন। তাদের সাথে কথা বলে জানাযায়, বছরের অন্য সময় তারা অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালান। আমন মৌসুমে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করেন। মৌসুমে ৯ থেকে ১০ মণ ধান পাওয়া যায়। তবে অনেক গর্তে ধান থাকে না। আবার ভাগ্য ভালো হলে এক গর্তেই মিলে যায় আধা মণ ধান। রহিমানপুর পটুয়ার মলিন বলেন, আমরা ইঁদুরের গর্ত থেকে ধানের শীষ সংগ্রহ করি। গৃহিনীরা সেই শীষ মাড়িয়ে বের করে ধান। কেউ কেউ কাঁচা ধান বেচে ফেলে, কেউবা সেদ্ধ করে বানায় চাল। ইঁদুর যেসব শীষ কেটে সঞ্চয় করে, তাতেই ভাগ বসাতে হয় আমাদের। আদিকাল থেকে কষ্ট করে আসলেও কোন ভাবে নিজস্ব স্থায়ী ঠিকানা হচ্ছে না। ইঁদুরের গর্ত থেকে ধানের শীষ বের করে কয়েক মাসের ভাতের ব্যস্থা হলেও বাকি মাস গুলো পরিবার নিয়ে মাঠে কাজ করে খুব কষ্টে দিন অতিবাহিত করতে হয় বলে সন্তানের পড়ালেখা করাতে পারি না। সরকার দেশের অনেক উন্নয়ন করছে কিন্তু আমাদের জন্য তেমন কিছু করছে না। আমাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন নেই। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুল আল মামুন বলেন, আদিবাসী বাউল শিল্পী মোনা পাহানদের মত বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না এবং তা বাস্তবায়নে সরকার নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে।’ ইতোমধ্যে উপজেলার অনেক আদিবাসী পরিবারকে জমিসহ পাঁকা বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে, যা চলমান থাকবে একজন মানুষ গৃহহীন থাকা পর্যন্ত।