পঞ্চগড় \ প্রবাদ ছিল, ‘অগ্রহায়ণের আট, যেখানে মন সেখানে ধান কাট’। এর মানে দাড়ায় অগ্রহায়ণের আট তারিখের পর মাঠের আমন ধান পেঁকে যাবে। যেখানে খুশি সেখানে ধান কাটা যাবে। কিন্তু দিন বদলেছে। এখন আর আমন ধান কাটার জন্য অগ্রহায়ণ মাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়না। এর প্রায় মাস দেড়েক আগেই মাঠজুড়ে পেঁকে আছে আমন ধান। ব্রি ধান, বিনা ধানসহ স্থানীয় অনেক জাতের ধান ইতোমধ্যে কর্তন শুরু করে দিয়েছেন কৃষকরা। নতুন ধান কেটে বাড়িতে আনায় নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে সৌরভ ছড়াচ্ছে কৃষকের ঘর। নতুন ধান কেটে মাড়াইয়ে পর কাঁচা খড়ের দামও বেশ চড়া। গোখাদ্য সংকটের কারণে শুকনো খড়ের পাশাপাশি কাঁচা খড়ও কিনছেন গো-খামারিসহ গরু পালনকারীরা। আবার ধান কাটার পর ওই জমিতে আলু, গমসহ শীতকালীন শাক সবজি আবাদ করে অধিক লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।
পঞ্চগড়সহ আশপাশের কয়েকটি জেলায় আশ্বিন-কার্তিক মাসকে বলা হত অভাবের মাস। আমন ধান রোপনের পর থেকে শষ্য কর্তন না হওয়া পর্যন্ত কৃষি শ্রমিকদের হাতে কোন কাজ থাকত না। অনেক শ্রমিক এই সময়টাতে কাজের সন্ধানে চলে যেত ভিন্ন জেলায়। কিন্তু দিন বদলে গেছে। এখন আর পঞ্চগড়সহ এই এলাকার লোকজনদের আর কাজের সন্ধানে খুব বেশি একটা জেলার বাইরে যেতে হয়না। আগাম জাতের ধান চাষ এবং সেই জমিতে আগাম শীতকালীন শাক সবজি আবাদ করার কারণে কৃষি শ্রমিকদের কাজ লেগেই থাকে প্রায় সারাবছর। শ্রমিকরা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে ধান কাটা, বাড়িতে আনা ও মাড়াইয়ের কাজে। অনেকে আবার জমি চাষের পর পরবর্তী আবাদের জন্য জমি তৈরী করছেন।
কৃষকরা জানান, বাপ-দাদার হাত ধরেই পঞ্চগড়ের কৃষকরা প্রকৃতি নির্ভর আমন ধান চাষ করে আসছেন। আগে অগ্রহায়ন মাসের শুরু থেকে আমন ধান কাটা শুরু হলেও এখন তার থেকে এক-দেড় মাস আগেই কৃষকরা ঘরে তুলতে পারছেন আমন ধান। আবার আদী জাতের ধানের চেয়ে আগাম জাতের ধানের ফলন পাচ্ছেন বেশ ভালই। পুরনো জাতের আমন ধান আবাদ করে যেখানে কৃষকরা প্রতি বিঘায় ৮-১০ মন ধান পেত; আগাম জাতের ধান আবাদ করে তারা ১৫-২০ মন পর্যন্ত ধান পাচ্ছেন। পঞ্চগড় জেলার মধ্যে অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকা তেঁতুলিয়া উপজেলার অনেক স্থানে এই ধান কাটা শুরু হয়েছে কয়েকদিন আগ থেকেই। শুরুতে ধানের দাম কিছুটা কম হলেও কাঁচা খড় বিক্রয় করে অধিক টাকা আয় করতে পারছেন কৃষকরা। এক বিঘা জমির ধান কেটে মাড়াইয়ের পর কাচা খড় হিসেবে ধানের আটি বাজারে বিক্রয় হচ্ছে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হচ্ছে। এতে করে ধান কাটা-মাড়াইয়ের খরচ উঠে যাচ্ছে। অনেকে আবার ধান কাটার পর দ্রæত জমিতে চাষ দিয়ে মাটি শুকিয়ে নিচ্ছেন। কিছু দিনের মধ্যে ধানের জমিতে আগাম জাতের আলু, সরিষাসহ শীতকালীন বিভিন্ন শাক-সবজি চাষ করবেন কৃষকরা।
পঞ্চগড় জেলা সদরের বলেয়াপাড়া গ্রামের কৃষক জয়নুল হক জানান, এবার তিনি আমন মৌসূমে তিনি ৫ বিঘা জমিতে আগাম গুটি পাড়ি জাতের ধান আবাদ করেছেন। ইতোমধ্য তিন বিঘা জমির ধান কাটা শেষ করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে ফলন এসেছে প্রায় ১৭ মণ। তিনি জানান, ধান কাটার পর সেই জমিতে চাষ দিয়েছেন। জমির রস শুকিয়ে গেলে সেই জমিতে গোবর সারসহ রাষায়নিক সার দিয়ে গম চাষ করবেন। বাড়ির পাশের জমি হওয়ায় কিছু জমিতে বাড়ির খাওয়ার জন্য শাক সবজিও লাগাবেন।
পঞ্চগড় কৃষি বিভাগের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাদেকুল ইসলাম জানালেন, আগাম জাতের বিনা ধান ১৭, বিনা ধান ৭, ব্রি ধান ৮৭ ও ৭৫ এবং হাইব্রিড জাতের কিছু ধান ইতোমধ্যে কর্তন শুরু হয়েছে। এছাড়া কৃষকদের নিজ উদ্যোগে লাগানো পারিজাত ধান যেমন স্বর্ণা পারি, গুটি পারি, সাদা পারিসহ নানান জাতের আগাম ধানও জমিতে পেকে আছে। পঞ্চগড়ে আগাম বৃষ্টি এবং বন্যা কম হওয়ায় অধিকাংশ কৃষক পারিজাত ধানের আবাদ করে থাকে। এই ধানের বিশেষত হল আগে জমিতে চারা রোপন করলে আগেই পাঁকে। অন্যান্য জাতের ধানের চেয়ে এই জাতের ধানের ফলন কিছুটা কম হলেও ধান কাটার পর ওই জমিতে আলু, গমসহ আগাম শীতকালীন শাক-সবজি আবাদ করা যায়। এতে তারা অধিক লাভবান হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্র মতে চলতি আমন মৌসূমে পঞ্চগড় জেলায় ৯৭ হাজার ৯১৮ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ৮৬ হাজার ৩৬০ মেট্রিক টন ধান। তবে মৌসূমের শেষে বৃষ্টিতে শেষ পর্যন্ত ৯৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চারা রোপন করা হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫৯৭ হেক্টর বেশী। এতে করে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও অনেক বেশি হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে গেছে