বিরামপুর প্রতিনিধি\ একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন মইনুল ইসলাম শামীম। অফিস শেষে গাড়িতে করে বাড়ি ফেরেন তিনি। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির পাশে প্রধান সড়ক হেঁটে পার হতেই তাঁর কানে ভেসে আসে কিচিরমিচির শব্দ। গাছের ডালে শত শত চড়ুই পাখিতে তাঁর চোখ আটকে যায়। পাখিদের কলরবে সারা দিনের ক্লান্তি নিমেষেই ভুলে যান তিনি।
ব্যাংক কর্মকর্তা মইনুল ইসলামের মতো প্রতিদিন সন্ধ্যায় শত শত চড়ুই পাখির কলরবে থমকে যান পথচারীরা। প্রকৃতিপ্রেমী দর্শনার্থীদের চোখ আটকে যায় গাছের ডালে। দিনাজপুরের বিরামপুর পৌর শহরের ঢাকা মোড়ে নূর গার্মেন্টস নামে একটি থানকাপড়ের দোকানের সামনে দুটি বকুলগাছ ও দুটি আমগাছে এমন দৃশ্য দেখা যায়।
স্থানীয় ব্যক্তিদের ভাষ্য, প্রতিবছর আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি চড়ুইপাখি আসে। তবে এসব পাখি কোথা থেকে আসে, তা কেউই জানেন না। প্রতিদিন শেষ বিকেলে পাখিগুলো দল বেঁধে দোকানের সামনে প্রায় ২৫ হাত দূরত্বের মধ্যে চারটি গাছের ছোট-বড় ডালে বসে। ভোর থেকেই গাছ থেকে উড়াল দিয়ে পাখিগুলো হারিয়ে যায় দূর আকাশে। আবার শেষ বিকেলে দল বেঁধে ফেরে গাছের ডালে।
২৬অক্টোবর বিকেলে ঢাকা মোড়ের পশ্চিমপাশে দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে থানকাপড়ের দোকানটির সামনে গিয়ে দেখা যায়, দুটি বকুলগাছের প্রতিটি ডালে সারিবদ্ধভাবে বসে আছে অসংখ্য চড়ুই পাখি। বকুলগাছে জায়গা না হওয়ায় পাশের দুটি আমগাছেও বসে আছে শত শত পাখি। এ ছাড়া চারটি গাছের ডালের নিচ দিয়ে টাঙানো শহরের কেব্ল অপারেটর ও ওয়াই–ফাই লাইনের তারের ওপর বসে আছে কয়েক শ পাখি। কোনো পাখি এক ডাল থেকে আরেক ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে, কিচিরমিচির করছে। পাখিরা পরস্পর যেন খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। এমন দৃশ্য দেখতে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পথচারীরা ভিড় করছেন। কেউ কেউ আবার মুঠোফোনে ছবি তুলছেন।
গাছের ডালে চড়ুই পাখির সন্ধ্যাকালীন মেলা বসার বিষয়ে নূর গার্মেন্টসের মালিক আবদুস সাত্তার মন্ডলবলেন, প্রতিবছর শীতের শুরুতে দোকানের সামনে দুটি বকুলগাছে কয়েক হাজার চড়ুই পাখি আসে। প্রায় ৬ বছর ধরে এসব পাখি এখানে আসছে। তবে পাখিগুলো কোথা থেকে আসে, তা জানেন না। প্রতিদিন নিয়ম করে সন্ধ্যায় এসে গাছে বসে, আবার খুব ভোরে চলে যায়। হয়তো তারা খাবারের খোঁজে বাইরে যায়। মাঠে আমন ওঠা শেষ হলে পাখিগুলো তাদের নিজের জায়গায় ফিরে যাবে।
আবদুস সাত্তার আরও বলেন, ভোরবেলায় পাখিগুলোর কিচিরমিচির শব্দ খুবই ভালো লাগে। সন্ধ্যায় ও ভোরে তাঁর পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীরা বাড়ির জানালা এবং ছাদ থেকে পাখিগুলোর আড্ডা উপভোগ করেন। অজানা জায়গা থেকে এসে এখানে আশ্রয় নেওয়া পাখিগুলোকে যাতে কেউ ক্ষতি না করে, সে জন্য আশপাশের সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বকুলগাছের নিচে কাঠের চৌকিতে ফলের দোকান করেন এনামুল হক। প্রতিদিন বিকেলে পাখিগুলো বসলে ওপর থেকে নিচে পাখির মল পড়ে। এ জন্য দোকানের ওপর শক্ত ত্রিপলের ছাউনি দিয়েছেন। এনামুল বলেন, ‘এত জায়গা থাকতে পাখিগুলো এখানে এসেছে, গাছগুলোকে হয়তো পাখিদের খুব পছন্দ হয়েছে। নিরাপদ মনে করেছে, তাই তো তারা এখানে এসেছে। যদিও আমার ক্রেতাদের একটু সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি এতগুলো পাখি এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে, এটি ভাবতেই তো ভালো লাগে।’
বিরামপুর উপজেলায় বন্য প্রাণী নিধন প্রতিরোধ ও জনসচেতনতায় কাজ করছে ‘স্বপ্নছোঁয়া সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। চড়ুই পাখিগুলোর বিষয়ে কথা হলে সংগঠনটির সভাপতি আরমান আলী বলেন, ‘চড়ুই পাখিগুলো প্রতিদিন বিকেলে এসে এখানে বসে। পাখিগুলো আমাদের জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এদের যাতে কেউ শিকার না করেন বা ভয়ভীতি না দেখান, সে জন্য আমাদের সংস্থার পক্ষ থেকে গত বছর সেখানকার দোকানদার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে জনসচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে।’