ছোট গল্প
“”স্মৃতি ঘেরা পীরপুর”
মাসুদুর রহমান মাসুদ
প্রচন্ড খরা রােদ, ভ্যাপসা গরম। রাস্তায় এক কিলােমিটারের লম্বা জ্যাম। ঢাকায়
নিউ মার্কেটে বউয়ের কিছু কেনা কাটা করার জন্য দোকানে ঘুরছি। গরমে ঘামে
শার্ট প্রায় ভিজে গেছে, খুব অস্বস্থি বােধ করছি।
এক ডাব বিক্রেতা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, স্যার একটি ডাব খান, ভাল
লাগবে।
প্রচন্ড পিপাসা পেয়েছে, লােকটির কথা না করতে পারিনি। দাম কত?
৫০
(পঞ্চাশ) টাকা। আচ্ছা পাঁচ টাকা কম দিয়েন, খান স্যার।
ভাল ডাৰ,ভয় করে বিসমিল্লাহ বলে পাইপ ডুবিয়ে টান দেওয়া শুরু করেছি। ভাবছি
ডাবে মেডিসিন দিয়ে অজ্ঞান পার্টিরাএমনি করে মানুষকে ডাব খাওয়ায় সর্বস্বান্ত
করে ।
তারপরেও আল্লাহর নাম করে পান করে ফেললাম। দাঁড়িয়ে আছি, ভাবছি
মাথা ঘুরছে নাকি।
দশ মিনিটের মতাে লােকটির সাথে কথা বললাম। বাড়ি কোথায়, থাকেন কোথায়?
চাচা ছেলে মেয়ে কয়জন? দেখলাম শরীরের ভেতরে বেশ শক্তি আসছে। ক্লান্তিবােধ
অনেক কেটে গেছে। ভাবলাম যাই হােক, লােকটি ঠগ বাটপার না। টাকাটা
লােকটিকে দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বউয়ের জন্য কাপড় কিনবাে মনেকরে এক
দোকানে ঢুকেছি। দেখি আমার মতাে পঞ্চাশ বছর বয়সি এক লােক, ডাব
বিক্রেতার মতাে মায়াময় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
একটু বিরক্ত বােধ করে পাশের দোকানে যাই। সেখানে গিয়ে কাপড়ের দাম করতে
গিয়ে দেখি লােকটি আবার সেখানে। আমার দিকে আগের মতাে তাকিয়ে আছে।
সে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাে আপনি কি মুনির? খুব চেনা মনে হচ্ছে
ততক্ষনে আমিও লােকটির আপাদ-মস্তক ভালাে করে তাকিয়ে দেখি। বলি কিরে,
তুমি সফিক না ও আমাকে জড়িয়ে ধরে।চৌত্রিশ বছর পরে তােকে দেখলাম, বলে সফিক আমার শরীর থেকে ওর শরীর
ছড়িয়ে নেয়। আমি জিজ্ঞেস করি তুমি এখন কি কর? শিক্ষকতা।
কোথায়,পীরপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। তার মানে আমরা যে স্কুল থেকে
এস.এস.সি পাশ করি। সফিক আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি কর?
এক কলেজে অধ্যাপনা করি। দুই বন্ধু মিলে পারিবারিক অনেক আলােচনা করি। সে
আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় এক রেস্টুরেন্টে।
আমি বিল দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করি সে দিতে দেয়নি।
আসার সময় খুব করে ধরে, পীরপুর আসৰি । দুই বন্ধু অনেক আলাপ করবাে।
তােকে দাওয়াত দিলাম।
সে মোবাইল নাম্বার দেয়। আমি ওকে আমার
গ্রামে যাওয়ার জন্য খুব অনুরোধ করি।সে বলে, আগে তুমি আস। তারপরে
আমিও আসবাে। তার শিক্ষাভবনে কাজ আছে।সে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
১৯৮৫ সালে আমার বাবার পীরপুর বদলী হয়। পােষ্ট মাষ্টার। সপরিবারে আমরা
পীরপুরে উঠি।
বাৰা বাসা ভাড়া নেয়। পীরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করে দেয়।
সফিক আমার বাল্য বন্ধু। ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে এস.এস.সি পর্যন্ত এক সাথে পরি।
এস.এস.সি পাশের পর বাবা বদলি হয়ে যায়। এর পর আর সফিক ও অন্যান্য
বন্ধুদের সাথে দেখা হয়নি। মনে পরে সেই সব দিন গুলাে এবং পীরপুরের কথা।
পীরপুর নামকরনের ক্ষেত্রে বিশেষ কারন আছে।
এক সময় এই এলাকায় অনেক পীর আউলিয়াদের আগমন ঘটে। তারা ধর্ম প্রচার
করে। পােষ্ট অফিসের পার্শ্বে প্রায় ৪ কিলােমিটারের মতাে এক গােরস্থান।
পৃথিবীতে এত বড় গােরস্থান আছে কিনা জানা নেই গােরস্থানে সিরাজ আউলিয়ার
মাজার আছে। তেরশ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ওই আউলিয়ার আগমন ঘটে । সে
এই এলাকায় ধর্ম প্রচার করে মানুষকে ইসলামের দিকে দিক্ষিত করে।
সফিক চলে যাওয়ার পর,পীরপুরের স্মৃতি গুলাে মনের মধ্যে নাড়া দিয়ে উঠে।
চোখের মধ্যে ভেসে উঠে পীরপুরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী,শাল ব্রিজ। প্রায় দশদিন
পর সফিকের কল আসে। আস্সালামু আলাইকুম, বন্ধু আমি সফিক।
ওআলাইকুমুস সালাম, চিনতে পেরেছি। সে বলল, কেমন আছিস? হ্যাঁ ভাল আছি।
তুমি কেমন আছাে সফিক? হ্যাঁ ভাল আছি। সফিক আমাকে খুব অনুরােধ করে
পীরপুরে আসার জন্য আর আমি ওকে যাওয়ার সম্মতি জানিয়ে দিই।
।নির্ধারিত দিনে সারারাত জার্নির পর,সকাল বেলায় ট্রেন পীরপুর স্টেশনে পৌছে।
স্টেশন দেখে ভূল জায়গায় নামলাম মনে করি। এখন অনেক বড় স্টেশন।
স্টেশনের পূর্ব পার্শ্বে সেই পােষ্ট অফিস। পােষ্ট অফিসটি দেখার জন্য মনটা ছটফট
করে উঠে। ধিরে ধিরে হাটা শুরু করি,পােষ্ট অফিসের দিকে।
পােষ্ট অফিসটি
দেখেই বুকটা হাহাকার করে উঠে। সব সময় স্মৃতিতে ভেসে উঠা আগের পীরপুর
আর নেই। অনেক বড় পরিবর্তন, সাত আট তালা বড় বড় বিল্ডিং।
কারুকার্যময় পােষ্ট অফিস,ৰাৰাকে
এই এলাকার লােকজন হুসেন
মাষ্টার বলে বাবাকে চিনত। ৰাৰাকে লােকজন খুব ভালবাসত।
পােষ্ট অফিসের উত্তর দিকে পীরের মাজার। সামনে এগিয়ে যাই। সকাল বেলায়
গােরস্থানে কবরের পাশে বয়স্ক এক লােক, দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছে।
পীরপুর মনভরে দেখার জন্য রাস্তায় হাটাশুরু করি। স্মৃতিতে লুকিয়ে থাকা চৌত্রিশ
বছর আগের পীৱপুর আর বর্তমান পীরপুর সবকিছুই যেন অচেনা শহরে পরিনত হয়ে গিয়েছে।
পীরপুর চৌরাস্তায় বড় এক রেষ্টুরেন্টে ঢুকে, হাত মুখ ধুয়ে নাস্তাকরি । সফিকের
কল আসে। মুনির পৌচেচ্ছাে? আমি বলি হ্যাঁ, সকালেই ট্রেন থেকে নেমে গােটা
পীরপুর হেটে হেটে দেখছি। তুমি এখন কোথায়? পীরপুর চৌরাস্তায় দাড়িয়ে আছি।
কয়েক মিনিট পরেই সফিক আমার কাছে আসে চৌৱস্তার পশ্চিম পার্শ্বে দুই
মিনিটের মতাে পথ হাটলেই পীরপুর হাইস্কুল। সে আমাকে পীরপুর হাইস্কুলে নিয়ে
আসে। স্কুলটির ব্যাপক পরিবর্তন,আগের ঘরগুলাে নেই।
নতুন নতুন বড় ভবন । পুরাতন আমলের অফিস ঘরটি এখনাে আছে। সেখানে
প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়। প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী,দেখে মনে শান্তি আসে। এই স্কুলে
আমিও লেখাপড়া করেছি।
ব্রিটিশ আমলের নাম করা এই এলাকার সবচেয়ে বৃহৎ স্কুল। পুরাতন স্যারদের কথা
জিজ্ঞেস করি। অনেকেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে।
আমাকে দেখে অফিসে বসা শিক্ষকরা সালাম দিয়ে বসার জন্য অনুরােধ করে।
সফিক স্যারদের বলে, আমার বন্ধু মুনির। চৌত্রিশ বছর আগে,এই স্কুলে আমরা
এক সাথে লেখাপড়া করি।
ওৱ ৰাৰা সেই সময়ের একজন পােষ্ট মাষ্টার ছিল। চাচা খুব ভাল মানুষ ছিল।
আমাদের খুব আদর করত। পিয়ন নাস্তা ও চা দেয়। এমন সময় এক অর্ধ বয়সি
মহিলা এলােমেলাে চুলে সালাম দিয়ে রুমে প্রবেশ করে। সফিককে জিজ্ঞেস করে।
স্যার আমার সূর্য কেমন লেখাপড়া করছে?ও কি এখনাে ক্লাসে দুষ্টুমি করে । সফিক সহ উপস্থিত শিক্ষকরা সবাই চুপ করে
আছে। সফিক পিয়নকে ডেকে বলে,উনাকে নাস্তা দাও। মহিলাটি হাসতে শুরু করে।
কিছুক্ষন চুপ থাকার পর, আবার কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বের হয়ে যায়। আমি
অবাক হয়ে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকি। সফিক সহ সকল শিক্ষকদেরকে মুখ
মলিন হয়ে উঠে।
আমি জিজ্ঞেস করতেই সফিক বলে, আমাদের অষ্টম শ্রেণীর এক মেধাবী ছাত্রের
মা। একমাত্র ছেলে গত বছর শ্রাবন মাসে,ক্লাস ফাকি দিয়ে কয়েক জন ছাত্র প্রাচীর
টপকে নদীতে গােসল করতে যায়।
সূর্য উনার ছেলের নাম। যেমনি মেধামি তেমনি চঞ্চল ও অস্থির । ভালাে সাঁতার
জানত। নদীর উপর ব্রীজ।ব্রীজের নিচে রাবার ড্রেম। আলাের প্রতিবিম্ব পানির
উপর পরায় ড্রেমের পানি একটু নিচে মনে করে সে। তারপর সে ড্রেমের উপর
লাফিয়ে পড়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠে। বন্ধুরা বাধা দেয় ও বলে আমি সাঁতার জানি,
সমস্যা নেই। ব্রীজের উপর অনেক মানুষ। অনেকেই বাধা দেয়,আমি সাঁতার জানি
বলেই ড্রেমের উপর লাফিয়ে পরে। প্রবল স্রোত ওকে ডুৰে নেয়। অনেক খােজা
খুজির পর লাশ ভেসে উঠে। সে থেকে ওর মা পাগল হয়ে গেছে।
কিছু কিছু সময় জ্ঞান থাকে আবার কিছু সময় জ্ঞান থাকেনা। তখন শুধুই কাঁদতে
থাকে। ছেলেটির লেখাপড়ার ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিল প্রায় স্কুলে আসত। এখন
এক মাস- দুমাস পর আসে আবার চলে যায়। একজন মায়ের এই অবস্থা দেখে
আমার চোখে পানি চলে আসে।
মনের পড়ে শালবাড়ির কথা। সেখানে নদীর উপর এখন অনেক বড় ব্রীজ হয়েছে।
আমরা ও এক সময়,স্কুল ফাঁকি দিয়ে শালবাড়ি আসতাম। নদীর পানির দেখতে।
বিকেল বেলা সফিক সহ শালবাড়ি নদীর ব্রীজ দেখতে আসি।অনেক মানুষ ব্রীজের
উপর। নদীতে প্রচুর পানি। রাবার ড্রেম প্রতিকুলের পানি বাধা দিয়ে ফুলিয়ে
দিয়েছে।
নদীর ধাৱে শালবাগান। একটি শালগাছের নিচে এক মহিলা
পানির দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে লােক জন চলে যাওয়া শুরু হয়েছে।
অনেকক্ষন হয়ে গেল,মহিলা গাছের নিচে বসে আছে।পানির দিকে তার করুন চাহনি!
আমার হৃদয়ে ব্যাথার সৃষ্টি করে । আমি তার দিকে এগিয়ে যাই।
দেখি সেই সূর্যের মা –
সকাল বেলায় কবরের পাশে দাঁড়িয়ে যে লোক হাত তুলে কাঁদছিলো। সে পিছন দিক থেকে মহিলার হাত ধরে টেনে তুলে। বলছে সূর্য ডুবে গেছে অন্ধকার নেমে আসছে চল, বাড়ি যাই।
লেখক,কবি ও শিক্ষক
মাসুদুর রহমান মাসুদ
পীরগন্জ, ঠাকুরগাঁও