বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর মাইন বিস্ফোরন ট্র্যাজেডী দিবস আজ ৬ জানুয়ারী। স্বাধনিতার অর্জনের কয়েকদিন পর ১৯৭২’র এই দিনে দিনাজপুরে এক আকষ্মিক মাইন বিস্ফোরণে শহীদ হন মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে আনা ৫ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। এই বেদনা বিধুর দিবসটি পালনে ‘৬ জানুয়ারী স্মৃতি পরিষদ’সহ বিভিন্ন সংগঠন কর্মসুচী নিয়ে থাকে।
দিবসটি পালনে ৬ জানুয়ারী স্মৃতি পরিষদ, দিনাজপুর’ বিভিন্ন কর্মসুচী গ্রহণ করেছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে, চেহেলগাজী মাজারে শহীদদের গণকবর ও মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গনে শহীদদের নামফলকে শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পন, আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে এবং মহারাজা স্কুল মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
১৯৭২’র ৬ জানুয়ারী সন্ধ্যায় এই রুটিন ওয়ার্কের এক পর্যায়ে ঘটে যায় মাইন বিস্ফোরন দূর্ঘটর্না, এতে শহীদ হন ৫শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা।
৬ জানুয়ারী দিবসটি সম্পর্কে বীরমুক্তিযোদ্ধা সফিকুল হক ছুটু বলেন, পাকহানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শত্রæমুক্ত হওয়ায় দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়ীর মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ট্রানজিট ক্যাম্প বসানো হয়। ৬ ও ৭নং সেক্টরের প্রায় এক হাজার মুক্তিযোদ্ধা এখানে অবস্থান করেন। ভারতের হরিরাম, হামজাপুর, তরফপুর এবং বাংলাদেশের নবাবগঞ্জ, ফুলবাড়ী, পার্বতীপুর, হাকিমপুর, বিরামপুর, দিনাজপুর সদর, চিরিরবন্দর, ঠাকুরগাঁও হরিপুর, পীরগঞ্জ, বালিয়াডাঙ্গা ও রাণীশঙ্কৈল এলাকার যোদ্ধারা ১৬ থেকে ২০ডিসেম্বরের মধ্যে মহারাজা স্কুলের ট্রানজিট ক্যাম্পে অবস্থান নেন। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের মাটি দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় হানাদার বাহিনীর পুতে রাখা মাইন এবং ফেলে যাওয়া ও লুকিয়ে রাখা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের কাজে ব্যস্ত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। প্রতিদিন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তল্ল¬াশি চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রাকে করে পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র মহারাজা স্কুলের ট্রানজিট ক্যাম্পের রক্ষণাগারে জমা করতেন।
৬ জানুয়ারী ১৯৭২ সাল। ঘোড়াঘাট থানার বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধারকৃত পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই দুটি ট্র্রাক আসে বিকেল ৪টায়। শুরু হয় ট্রাক থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাসের কাজ। সোয়া ৫টার দিকে প্রথম ট্রাকের অস্ত্র নামানোর কাজ শেষ হয়। তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় ট্রাকটির অস্ত্র নামানোর কাজ। ট্রাক থেকে বাংকারে অস্ত্র নামানোর সময় একজনের হাত থেকে অসাবধানতা বশত কয়েকটি পারসোনাল মাইন মাটিতে পড়ে গেলে মারাতœক ও হৃদয়বিদারক দূর্ঘটনার সৃষ্টি হয়। মুহুর্তের মধ্যে বাঙ্কারে মজুদকৃত বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়।
প্রায় ১৫ থেকে ২৫ ফুট গভীর বিরাট বাঙ্কারটির আশপাশ ফাকা জায়গাটি পুকুরে পরিনত হয়। দূর্ঘটনা সময় অদুরে টিনের ছাপড়ার মসজিদে মাগরিবের সামাজ আদায়কারী সকল মুসলিল্ল ও দূর্ঘটনা থেকে ১৫০গজ অদুরে মহারাজা স্কুলের ১৩টি কক্ষ অবস্থানরত অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা এ মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় নিহত হয়। তৎকালীন মহারাজার আমলে নির্মিত এই স্কুল ভবন মাইন বিস্ফোরণে দুমড়ে-মুচড়ে কাগজের মতো হয়ে যায়। ভয়াবহ এ মাইন বিস্ফোরনে কতজনের নিমর্ম মৃত্যু হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা আজও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নয়, এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় উত্তর বালুবাড়ী কুমার পাড়া এলাকার আরো ১৫জন অমুক্তিযোদ্ধাও মৃত্যুবরণ করেন। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় মহারাজা স্কুলের দ্বিতল ভবনসহ আশেপাশের অধিকাংশ ঘর-বাড়ী, দালান-কোঠা।
দূর্ঘটনার পরদিন ৭ জানুয়ারী দিনাজপুর গোরা শহীদ ময়দানে শহীদদের নামাজের জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পরে সামরিক মর্যাদায় ১২৫জন শহীদের লাশ দাফন করা হয় পূন্যভূমি ঐতিহাসিক চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে। এরপরে চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে আরও দাফন করা হয় হাসপাতালের মৃত্যুবরণ করা ২৯জনের লাশ। নিহতদের মধ্যে সে সময়ে ৫৮জনের নাম পরিচয় পাওয়া যায়। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে পাওয়া যায় আরো ৬৪ জন শহীদের নাম ও পরিচয়।