ঠাকুরগাঁও: রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামে ঠাকুরগাঁওয়ের দবিরুল ইসলাম বারবার কারারুদ্ধ হয়ে নির্যাতনের শিকারে অকালেই প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকা রাখা দবিরুল ইসলামের স্বীকৃতি ও স্মৃতি সংরক্ষেণের নেই উদ্যোগ। তাই হতাশা আর চাপা ক্ষোভ পরিবারটির, তাকিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকে। জেলা প্রশাসনও স্বীকার করে বলছেন, যথাযথ মর্যাদা দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে চিঠি দেওয়া হবে।
তখন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন দবিরুল ইসলাম। ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহপাঠি। ১৯৪৯ থেকে ৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। জেলা সুদুর ঠাকুরগাঁওয়ে সেই সময় মাতৃভাষা সংগ্রামের সাথে জড়িত ছিলেন দবিরুল ইসলাম। ১৯৪৯ সালে ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষনা হলে নিজ জেলায় চলে আসেন দবিরুল ইসলাম। ওই বছরের ১৩ মার্চ পূর্ববঙ্গ বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যোন্স বলে গ্রেফতার করে দবিরুল ইসলামকে। দিনাজপুর কারাগারে কারারুদ্ধ হন তিনি। কারা কর্তৃপক্ষ সরকারি মুসলিমলীগ কর্তাদের ইঙ্গিতেই দবিরুল ইসলামের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। এ সংবাদ শুনে দবিরুল ইসলামকে দেখতে দিনাজপুর ছুটে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তখন ১৪৪ ধারা জারি থাকায় বঙ্গবন্ধু তাঁর সাথে দেখা করতে পারেনি। কারাগারে ঘন্টা বাজিয়ে অকথ্য সেই নির্যাতনের কথা যে কেউ শুনলে আতকে উঠবে। এসব মনে হলে নিস্তব্দ হয়ে যান দবিরুল ইসলামের স্ত্রী আবেদা খাতুন। তিনি বলেন আবেদা খাতুন , তাঁর স্বামী মারা গেছেন আজ সব ধুয়ে মুছে গেছে। যখন বেঁচে ছিল তিনি দেশের জন্য কাজ করেছেন।
এর পর ৫২ ভাষা আন্দোলনে এ্যাড.দবিরুল ইসলাম তৎকালীন দিনাজপুর জেলায় আসেন আইন পেশায়। তখন রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবিতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সক্রিয় ভাবে ভুমিকা পালন করায় তৎকালীন সরকার দবিরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করে রাখেন। সেই সময়ও তিনি নির্যাতনের শিকার হয়ে ১৯৬১ সালের ১৩ জানুয়ারি অকালে ঝরে পড়েন দবিরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দবিরুল ইসলামকে নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন কথা লিখে গেলে আর কেউ তার স্মৃতি সংরক্ষণ করেননি। প্রয়াত দবিরুল ইসলামের পরিবার বঙ্গবন্ধুর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার পিতার যথাযথ মুল্যায়নের আবেদন করেছেন। সেই সময় ঠাকুরগাঁও বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আকবর হোসেন। তিনিও তার বন্ধুদের নিয়ে রাস্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবিতে হাতে লিখেছেন পোষ্টার। তা বিভিন্ন স্থানে লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, ভাষা সংগ্রামে বৃহত্তর দিনাজপুরে অন্যতম ছিলেন প্রয়াত এ্যাড.দবিরুল ইসলাম। তিনি তখন বেশিরভাগ সময়ই জেলে ছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি মূল্যায়িত হননি। এটা জাতির লজ্জাজনক।
প্রয়াত দবিরুল ইসলামের ছেলে আহসান হাবীব বুলবুল বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেচে থাকলে তার বাবাকে মূল্যালয়ন করতেন। কারণ তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহপাঠি। তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তার পিতার কর্মজীবন মূল্যায়ন করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন প্রয়াত দবিরুল ইসলামের ছেলে আহসান হাবীব বুলবুল।
ভাষা আন্দোলনে দবিরুল ইসলাম অগ্রনী ভুমিকা রাখায় ২০১৪ সালে ২১ ফেব্রæয়ারি তাঁর স্মরণে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসন শহরের কালীবাড়িস্থ সাধারণ পাঠাগার চত্বরে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মান করে। প্রতিবছরের ভাষার মাসে ২১ ফেব্রæয়ারি পালনে ওই স্মৃতি সৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় ঠাকুরগাঁওয়ে সর্বস্তরের মানুষ। প্রশাসনের নজরদারি অভাবে প্রায় প্রতিদিনই এভাবেই অবমাননা করা হচ্ছে দবিরুল ইসলামর স্মৃতি সৌধটি। জেলা প্রশাসক ড.কেএম কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, ভাষা সংগ্রামে অবদান রাখা দবিরুল ইসলামের যথাযথ মর্যাদা দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে চিঠি পাঠানো হবে।
স্থানীয় ভাবে স্বীকৃতি পেলেও দবিরুল ইসলাম আজও ভাষা সৈনিক হিসাবে স্বীকৃতি পাননি। তাই ভাষা আন্দোলনে ভুমিকা রাখা মানুষ গুলোর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ ও স্বীকৃতির স্থায়ী ভাবে রুপ দেওয়ার দাবি উঠেছে।