পঞ্চগড়ে ২৫ বছরের সৌরচালিত বিদ্যুত পাম্প এক বছরেই নষ্ট
সুদ আসলে ১৫ কোটি টাকা ঋণের টাকা
আদায়ে চলছে মামলা-জমি নিলাম
পঞ্চগড় প্রতিনিধি\ বিদ্যুৎ সুবিধা না থাকায় অথবা লোডশেডিং এর কারণে কৃষিকাজে ব্যাঘাত ঘটায় নিরবিচ্ছিন্ন সেচ পাম্প চালাতে পঞ্চগড়ে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে সেচ পাম্প চালাতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে একটি বেসরকারি ব্যাংক। ওই ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষক সমবায় সমিতি গঠন করে ঋণের টাকায় বসানো হয় সৌরচালিত সেচ পাম্প। অভিযোগ রয়েছে, ২০-২৫ বছরের জন্য এই সেচ পাম্প বসানো হলেও নি¤œমানের প্যানেল ও যন্ত্রাংশ দেয়ায় স্থাপনের এক বছরের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে আছে সেচ পাম্প। আর কৃষকরা বাধ্য হয়ে সেচ কার্য চালাতে গভীর নলকুপ স্থাপন করে তাদের জমিতে চাষাবাদ করছে। এতে করে ফসলের উৎপাদন খরচও অনেক বেড়ে যাচ্ছে। সেচ পাম্প থেকে কোন আয় না থাকলেও মূল ঋণের সাথে দ্বিগুনের বেশি সুদের টাকা আদায়ে মামলাসহ জমি নিলাম করছে ব্যাংকটি। এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে পঞ্চগড়ের ১১টি কৃষক সমবায় সমিতির সহ¯্রাধিক কৃষক।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বেংহারী বনগ্রাম ইউপির মালিপুকুরী কৃষক সমবায় সমিতির সভাপতি আনিসুর রহমান জানান, কৃষকদের কৃষিকাজে সহায়তা করার জন্য মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের দুইজন কর্মকর্তা ইকবাল ও কিবরিয়া পঞ্চগড়ে এসে সদর ও বোদা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে কৃষক সমবায় সমিতি গঠন করার পরামর্শ দেন। সমিতির সদস্যদের কৃষি ঋণ দেয়ার পাশাপাশি ব্যাংকের অর্থায়নে পরিবেশ বান্ধব ও নিরবিচ্ছিন্নভাবে সৌর বিদ্যুত চালিত সেচ পাম্প স্থাপনের কথা বলেন। তাদের কথামত পঞ্চগড় জেলায় ১১টি কৃষক সমবায় সমিতি গঠন করা হয়। এসব সমিতির সদস্যদের কৃষি ঋণ দেয়ার পাশাপাশি ১৭টি সৌর বিদ্যুৎ চালিত সেচ পাম্প বসানোর জন্য ব্যাংকের ঠাকুরগাঁও শাখার মাধ্যমে গ্রীণ এনার্জি (এগ্রিকালচার বেসড ঋণ) প্রকল্পের আওতায় কৃষক সমবায় সমিতিগুলোর সদস্যদের জমি বন্ধক রেখে পাঁচ কোটি ৩০ লাখ টাকা ঋণ বরাদ্দ করা হয়। সেই ঋণের টাকা দিয়ে রহিম আফরোজ ও শেরপা নামের দুইটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ১৭টি সৌর বিদ্যুৎ চালিত পাম্পের জন্য প্রয়োজনীয় প্যানেল ও যন্ত্রাংশ স্থাপন করা হয়। নির্মাণ করা হয় প্রয়োজনীয় ড্রেন। তারা বলেন যে, প্রতিটি পাম্প দিয়ে ২০ থেকে ২৫ বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে ১শ থেকে ১৫০ বিঘা জমিতে সেচ কার্যক্রম চালানো যাবে। প্রকল্পগুলো দেখভালের জন্য দুই সোলার কোম্পানীর দুইজন প্রতিনিধি এলাকায় দায়িত্ব পালন করে। শুরুতেই প্যানেল, পাম্প ও যন্ত্রাংশের মান নিয়ে কৃষকদের সন্দেহ থাকলেও তারা তা উড়িয়ে দেন। প্যানেল স্থাপনের প্রথম বছর ভাল সার্ভিস দিলেও পরবর্তি বছর থেকেই সমস্যা শুরু হয়। সারাদিন সূর্যের আলো থাকলেও পাম্পে পানি ওঠা কমতে থাকে। ওই পানি দিয়ে ৮-১০ বিঘা জমিতে সেচ কার্য চালানো যায়। এভাবে দুই বছর চলার পর দেখা যায় পাম্প চালুই হচ্ছে না। অকেজো হয়ে আছে। এ নিয়ে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও প্যানেল স্থাপনকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে বার বার যোগাযোগ করেও তারা কোন ফল পায়নি। বাধ্য হয়ে তারা তাদের সৌর বিদ্যুত চালিত সেচ পাম্প ফিরিয়ে নিয়ে ঋণ থেকে মুক্তি পেতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছে। তিনি আরও বলেন, এই প্রকল্পগুলো পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেয়া হলেও এর আয় দিয়ে কোনভাবেই ঋণ পরিশোধ সম্ভব হবে না।
বোদা উপজেলার বেংহারী ইসলামপুর গ্রামের কৃষক জহিরুল ইসলাম জানান, আমি প্রকল্পের পানি দিয়ে এক বিঘা জমিতে আবাদ করেছিলাম। খরচ অনেক কম পড়েছিল। দুই বছর পরই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। তাই আমি বাধ্য হয়ে এখন অন্যের কাছে শ্যালো মেশিনের পানি নিয়ে আবাদ করছি। এতে করে আমাদের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার উপজেলার বেংহারী বনগ্রাম ইউনিয়নের বেংহারী ইসলামপুর আদর্শ কৃষক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম বলেন, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা ইকবাল সাহেব ঠাকুরগাঁও শাখার মাধ্যমে ২০১২ সালে ৭০ লাখ টাকার ঋণে আমাদের দুইটি সৌর বিদ্যুত চালিত সেচ পাম্প স্থাপন করে দেন। কিন্তু এক বছর চলার পর থেকেই দুইটি পাম্পই অকেজো হয়ে আছে। আমরা ব্যাংক ও সোলার স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান সেরপা কোম্পানীর সাথে বহুবার যোগাযোগ করেও তারা আমাদের কোন কথাই শুনছে না। পাম্প দিয়ে কোন সেচকার্য করতে না পারায় আমাদের কোন আয় হচ্ছে না। তাই আমরা ঋণের কিস্তিও দিতে পারছি না। আমরা এখন কিভাবে এই ঋণ পরিশোধ করব।
এ নিয়ে কথা বললে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ঠাকুরগাঁও শাখার ব্যবস্থাপক তাইমুর হোসাইন বলেন, এই ঋণটি দেয়া শুরু হয়েছিল ২০১২-১৩ সাল থেকে। ইতোমধ্যে ১০ বছর চলে গেছে। সমস্যা শুরু হওয়ার পর তারা তো আমাদের জানায়নি। সমস্যা সমাধানে আমরা সমিতির নেতৃবৃন্দ এবং কোম্পানীর লোকজনকে একাধিকবার ডেকেছিলাম। তাদের কোন আগ্রহ দেখিনি। এই প্রকল্পে ঋণ দেয়া হয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংকের টাকা তো জনগনের টাকা। ঋণের টাকা তাদের পরিশোধ করতেই হবে। তাদের জন্য গত আড়াই বছর ধরে দু’টি ঋণের জন্যই সুদ জিরো করা হয়েছে। এর চেয়ে আমাদের আর করণীয় কিছুই নেই। তিনি এ নিয়ে নেতিবাচক নিউজ না করার অনুরোধ করেন।
মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ইকবালের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সৌর বিদ্যুৎ চালিত সেচ প্রকল্প সারাদেশের মধ্যে একটি সফল প্রকল্প। আমি ব্যাংকে থাকাকালে সফলভাবেই এই প্রকল্প চলমান ছিল। কৃষকরাও এই প্রকল্পে উপকৃত হয়েছে। তাদের আয় দিয়েই ঋণের কিস্তি পরিশোধ হয়েছিল। আমি সেখান থেকে চলে আসার পরই ব্যাংক কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে প্রকল্পটি রুগ্ন হয়ে পড়ে। দুই সোলার কোম্পানীর দুইজন প্রতিনিধিও সেখান থেকে চলে যায়। তিনি দাবি করে বলেন, প্রকল্পটিতে কোন ধরণের অনিয়ম হয়নি। ব্যাংকের নিয়ম মেনে সব কিছু করা হয়েছে। এখন আমাকে দোষারোপ করে কোন লাভ নেই। এখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষের উচিৎ সমিতির নেতৃবৃন্দদের সাথে নিয়ে সোলার কোম্পানীর মাধ্যমে পুনরায় প্রকল্পগুলো চালু করা। সেখানে আমাকে প্রয়োজন হলে আমিও যাব। প্রকল্পগুলো চালু হলে সেখানকার আয় দিয়েই ঋণ পরিরোধ করা যাবে। এ ছাড়া এই সমস্যা সমাধানের আর কোন উপায় নেই বলে তিনি জানান।