• পাড়ার রাস্তার মােড়ে মামুন সহ বেশ কিছু লােক বর্তমান
করােনার ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করছে।
কারাে
মুখে মাস্ক, কারাে মুখে মাস্ক নেই। খবরের কাগজ, টিভির
প্রতিদিনের মৃত্যুর সংবাদ সবার মধ্যে ভীতির সঞ্চার সৃষ্টি
করেছে।
গ্রামের সলিম চাচা উদবিগ্ন ও অস্থির হয়ে আমাদের
কাছে আসলেন।
প্রাইমারী স্কুলে চাকুরী করতেন। অবসর প্রাপ্ত বয়স
প্রায় তিয়াত্তরের মতাে। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমার বড়
ছেলের জন্য দোয়া করবেন ও খুব অসুস্থ। মামুন জিগ্গাসা করলেন,
চাচা হুসাইনের কি সমস্যা?
কয়েক দিন আগে ওর মাকে মােবাইল করেছিল, বলেছিল জ্বর
হয়েছে , সাথে গলা ব্যথা। এন্টিবায়ােটিক সহ জ্বরের ঔষধ
খাচ্ছে। আজকে দুপুরে ওর মাকে আবার মােবাইল করেছে।
কাঁশতে কাশঁতে কথা বলতে পারছেনা। কথাগুলাে বুঝা যাচ্ছেনা।
.
মাফ-মাফ করেই মােবাইল শেষ করেছে। বউ মাকে কল
দিলাম, বউমা কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বললাে বাবা ওর অবস্থা
ভালাে না, শ্বাস কষ্ট হচ্ছে?
নাইমকে কল দিয়েছি। ও আসছে,
আসলেই মেডিকেলে নিয়ে যাবাে।
মামুন বললাে, এতাে করোনার লক্ষন। গল্প শেষ হতে না হতেই
সলিম চাচার বাড়ির কাজের মেয়েটির ছােট ছেলে দৌড়ে এসে
বললাে , দাদা ঢাকা থেকে ফরিদা চাচি কল দিয়েছে।খুব কাঁদছে।
দাদি আপনাকে ডাকলাে।
ফরিদা হুসাইনের স্ত্রী। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে।
ছেলেটি ক্লাস নাইনে, মেয়েটি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে।
সলিম চাচার
বড় ছেলে হুসাইন ও ছােট ছেলে নাইম। দুজনে
ঢাকায় থাকে। কোম্পানিতে চাকুরী করে। নাইম এসে
মেডিকেল পর্যন্ত হুসাইনকে অ্যামবুলেন্সে করে নিয়ে গিয়েছিল।
কর্তব্যরত
ডাক্তারা মৃত্যু ঘােষনা করে। এই মাত্র খবর আসল হুসাইন করোনায়
মারা গেছে। গােটা পাড়ার মানুষ থমথম হয়ে উঠে।
হুসাইনের বাবা মায়ের বুক ফাটা কান্না বাড়ির চারপাশে ভারি হয়ে
উঠেছে। মামুন ও কাঁদছে! হুসাইন ও মামুন সমবয়সি।
এক সাথে বড় হয়েছে। স্কুল জীবনে এক সাথে লেখাপড়া
করেছে।
হুসাইন পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউটে ডিপ্লোমা ইঞ্জিয়ারিং এ ভর্তি হয়।
মামুন সখিগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে লেখা পড়া করে।
একদিন হুসাইন ও মামুনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। হুসাইন
খারাপ ভাষা প্রয়ােগ করলে মামুন রাগে ওর গালে একটি ঘুষি
মারে । ঘুষিটা ওর কপালে গিয়ে ঠেকে। তার কপালে ছিল একটি
ফুসড়ি ঘা। মামুনের অনামিকা আংগুলে ছিল একটি আংটি।
আংটির উপরের অংশ ওর ফুসরির মধ্যে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে রক্ত গড় গড় করে পরতে শুরু করে।
মামুন ভয়ে দৌড় মারে। গ্রামের কিছু দুষ্ট মানুষ, দুই বন্ধু ও দুই
পরিবারের মধ্যে দুরত্ব তৈরি করতে মামলার প্রস্তুতির জন্য
হুসাইনকে মেডিক্যালে ভর্তি করে। মামুন সেই সময় সখিগঞ্জ
ডিগ্রি কলেজে বি.এস.সি পড়ত।
পরবর্তীতে সলিম চাচা ও মামুনের পরিবার মিলে বিষয়টি সমাধান
করে। দুজনের মধ্যে মিল করে দেয়। হুসাইন একদিন মামুন দের
বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে আসে। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক হয়ে যায়।
এদিকে হুসাইন ডিপ্লোমা ইঞ্জিয়ারিং শেষ করে। সখীগঞ্জ বিদ্যুৎ
পাউয়ার হাউসে এক মাসের জন্য ব্যবহারিক ক্লাশ করতে আসে।
মামুনের সেই সময় বি.এস.সি ফাইনাল পরীক্ষা শেষের
দিন। শহরের চারজন নেশা খাের খারাপ প্রকৃতির ছেলে মামুনের
পিছু নেয়। কয়েক দিন আগে তারা
মামুনের মেসেও গিয়েছিল মামুনকে খোঁজার জন্য।
মেসের এক বন্ধু বলেছিল মামুন তােকে কয়েকজন খারাপ ছেলে
খুজছিল। নেশা খাের। তাদের মতলব ভালাে না। সাবধানে
থাকিস। মামুনের সন্দেহ হয়,এরাই হয়তাে তাকে খুজছিল।
মামুনকে চাকু দেখিয়ে রিক্সা থেকে নামিয়ে ভীষন পেটাতে থাকে।মামুনের নাক ও শরীর থেকে রক্ত পরছে।মামুন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বন্ধুরা মামুনকে রিক্সা করে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে।মামুনের জ্ঞান ফিরে। মামুন দেখে,
নেশাখোর কয়েকজনের মধ্যে একজন মামুনের গায়ে হাত দেয়নি। সে দূরে দাঁড়িয়ে মামুনের বন্ধুদের সাথে ধোস্থাধোস্থি করছিল।
সে হাসপাতালে আসে মামুনকে দেখতে।মামুন ওর হাত ধরে বলে কেন তোমরা আমাকে এভাবে পিটালে?
সে বলেছিল হুসাইনের সাথে তোমার কি হয়েছিল?
প্রতিশোধ নিতে সে আমাদের ঠিক করে।বিনিময়ে নেশা কেনার জন্য কিছু টাকা দেয়।আমি অবাক হয়েছিলাম।সেদিন বুঝেছিলাম ক্রোধ মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে। হয়তো পিটুনিতে মরে যেতাম রাখে আল্লাহ মারে কে। এরপর যা হবার আগের মতো ক্ষমা চাওয়া চায়ি।বিষয়টি নিয়ে মামুনরা আর দৌড়ায়নি। দুই বন্ধুর কথা কাটাকাটি হওয়াই একটি ঘুষি থেকে কত কি ঘটে গেল।এরপর হুসাইনের ঢাকায় ঔষধ কোম্পানিতে চাকুরী হয়।আঠাশ বছর কেটে যায়।এর মধ্যে পাড়ায় মামুনের সাথে দুই তিনবার দেখা হয়।সে লজ্জায় মাথা নিচু করে চলে যায়।তাদের মধ্যে আর কোনোদিন কথা হয়নি।
হুসাইনের মৃত্যুর খবরটি মামুনকে ভীষণ পিড়া দেয়। মামুন নামাজে আল্লাহর কাছে কাঁদতে কাঁদতে দোয়া করে। তার জন্য ক্ষমা চায়।
তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি বন্ধু আল্লাহ যেন তােমাকে
জান্নাত দান করে।ওপারে ভালো থাক।
রাতে কবর খুড়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। সকালে ঢাকা থেকে একটি
বিশেষ গাড়িতে করে লাশ আসে। লােকজন দুর থেকে দেখছে।
করোনায় মৃত্যুর কারনে কাছে কেউ যাইনি। নির্দিষ্ট চারজন
প্রশিক্ষন প্রাপ্ত ব্যক্তি আগে থেকে প্রস্তুত ছিল তারা লাশ কবরে
নামায়। তার পিতা মাতা স্ত্রী সন্তানের কান্নায় উপস্থিত সকলের
চোখে পানি।
মৌলানা সাহেব বললেন, কাঁদবেন না সকলে দোয়া
করেন। সবাই হাত তুলে দোয়া করে।
কয়েক দিন হয়ে গেল। মামুনের দুঃশ্চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না। করোনায়
আতংকে টিভি দেখা বন্ধ করে দিয়েছে।
শরীরটা তার মেজ মেজ করছে। জ্বর জ্বর মনে হচ্ছে মাথা ব্যাথা।
রাত গভীর হয়েছে জ্বর বেড়ে গেছে। স্ত্রী ও কন্যা
ঘুমাচ্ছে। একের পর এক দুঃচিন্তা মন ভেঙ্গে দিচ্ছে।
মামুন
ছাদের উপরে উঠে। অন্ধকার রাতে আকাশে তারা দেখতে ভালাে
লাগে। শরীর ঘামা শুরু করেছে। ঠান্ডা হাওয়া বেশ ভালাে
লাগছে। ছাদে শুয়ে পরে। তারা গুলাে কি সুন্দর ভাবে জ্বলছে!
পৃথিবীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পাশের গাছটিতে
একটি পেচাঁ ক্রমাগত ডেকে চলেছে। কুলক্ষনে এই ডাক।
তার মন দূর্বল করে দিচ্ছে। না জানি তার করোনা হয়েছে। হঠাৎ করে
একটি উল্কা আকাশে জ্বলে উঠে ধপ করে নিভে যায়।
মামুন ভাবে পৃথিবী বড় মায়ার তবুও উল্কার মতাে একদিন নিভে যেতে হবে।
মাসুদুর রহমান মাসুদ
লেখক,কবি ও শিক্ষক
পীরগন্জ ঠাকুরগাঁও