বিকাশ ঘোষ, বীরগঞ্জ(দিনাজপুর)প্রতিনিধি- আত্মবিশ্বাস এমনই একটি শক্তি
যা দুর্বলকে সাহস যোগায়। শত প্রতিকূলতার মাঝেও মানুষকে সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখায়। মানুষ যত খারাপ অবস্থাতেই পড়ুক না কেননা সে যদি তার আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে পারে। তার স্বপ্ন পূরণের জন্য পরিশ্রম করে, তবে সে এই পরিস্থিতি থেকে এক সময়ে নিশ্চই বেরিয়ে
আসবে। সাফল্য জন্মায় পরিশ্রমে এবং সেই সব ব্যক্তিদের আত্মবিশ্বাসে যারা দূর্বলতাকে
সফলতায় পরিণত করার সাহস রাখেন দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের বড়হাট গ্রামের মোছা. আনোয়ারা বেগম (৩০)। বিয়ের পর থেকে অভাব ছিল তার সংসারের নিত্য সঙ্গী, দীর্ঘদিন ধরে সংসারে অভাব অনটন এর সাথে যুদ্ধ করে আসছে। এক এক করে ৩ টা ছেলে মেয়ে
জন্ম দিয়েছেন। দিন দিন পরিবার বড় হচ্ছিল তার। পরিহাসের বিষয় হল, দিন দিন পরিবারের অভাবও
বেড়েই যাচ্ছিল। সমাজে তার কোন ভালো অবস্থান ছিলো না। ছেলেমেয়েদের নিয়মিত খাবার
দিতে পারত না, রোগবালাই নিয়মিত লেগেই থাকতো পবিবারের সদস্যদের। জানত না বেড়ে উঠার
জন্য শিশু অধিকার, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য বিষয়ে কতটা প্রয়োজনীয়। তার স্বামী তাইজুল ইসলাম (৩৫) ছিল পরিবারের উপার্জনকারি ব্যক্তি, যিনি দিনমজুরের কাজ করতেন। প্রতিদিন দুবেলা ঠিকমত খেতে পেত না, কারণ দিনমজুরের কাজ সবসময় পাওয়া যেত না। অভাবের সংসারে যেখানে খাবার জুটে না সেখানে ছেলে মেয়ের পড়ালেখা ছিল বিলাসিতার মতো। তাই বড় ছেলেকে পড়ালেখা
ছাড়িয়ে বাবার সঙ্গে কাজে পাঠায় এবং ছোট ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি তখনও জানত না একটি শিশুর জীবনে পড়ালেখা কতটা গুরত্বপূর্ণ। জীবন থেকে কোনদিন অভাব দূর হয়ে তিন বেলা ভরপেটে খেতে পাওয়া তাদের কাছে ছিল স্বপ্নের মত। কখনো ভাবিনি সচ্ছলতার মুখ দেখবো। প্রতিদিন বেঁচে থাকা ছিল একটা যুদ্ধ। আজ সমাজে ভাল অবস্থান হয়েছে।
ভাবতে অবাক লাগে অবশেষে দারিদ্রতা নামক দানবকে পরাজিত করেছেন। তাদের এলাকায় বীরগঞ্জ
এপি, ওর্য়াল্ড ভিশন বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজ করলেও তাদের ওয়ার্ল্ড ভিশন সম্পর্কে খুব বেশি
ধারণা ছিল না। সে ওয়ার্ল্ড ভিশনের কর্মীদের পরামর্শে তাদের বিভিন্ন শিক্ষনীয় সেশনেঅংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখান থেকে শিশু অধিকার, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উন্নয়ন এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারে। একটা শিশুর জীবনে শিক্ষা কতটা গুরত্বপূর্ণ
তা ওয়ার্ল্ড ভিশনের সেশন থেকেই জানতে পারে। মেয়ে তানজিনা আক্তার (১০) ওয়ার্ল্ড ভিশনের
নিবন্ধিত শিশু হিসেবে নির্বাচিত হয়। এরপর ২০১৫ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ভিশনের সাথে তাদের সুদিনের যাত্রা শুরু হয়। ওয়ার্ল্ড ভিশন থেকে বিভিন্ন ধরণের আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প গ্রহণ,
আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি ও গাভী পালনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু হয় তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। ওয়ার্ল্ড ভিশন থেকে তাদের জীবনযাত্রার উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে বিনামূল্যে একটি বকনা বাছুর প্রদান করা হয়। এছাড়াও বাড়ির আঙিনায় পতিত জমিতে কিভাবে সবজি চাষ করে পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিক্রি করে আয় করা যায় সে সম্পর্কে ওয়ার্ল্ড ভিশন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়ির পাশে খালি জায়গাতে বিভিন্ন ধরনের
সবজি চাষ শুরু করেন। ওয়ার্ল্ড ভিশন থেকে পাওয়া বকনা গরু বড় হয়ে চার বছরে ৪টি বাছুর জন্ম
দেয়। পরিবারের চাহিদা মিটানোর পরেও নিয়মিতভাবে দুধ বিক্রি করে। বাড়িতে কিছু হাঁস মুরগী পালন করে ও পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মিটিয়ে ডিম বিক্রি করেন। এখন তার আয়ও বাড়ছে। সেই সাথে ছেলেমেয়েরা এখন নিয়মিত স্কুলের পড়া চালিয়ে যাচ্ছে। এখন সঞ্চয়ের গুরত্ব বিষয়ে
ভালভাবে জানে তাই নিয়মিতভাবে সঞ্চয় জমায়। বর্তমানে সঞ্চয়ের বিশ হাজার টাকা ও দুইটি ষাঁড় বিক্রির ৮০ হাজার টাকা দিয়ে ২৫ শতক জমি দীর্ঘমেয়াদি (১০বছর) ইজারা নেয়। তার স্বামী এখন আর অন্যের জমিতে কাজ করে না। এখন তাদের জমি আছে, ইজারানেয়া জমিতে আমরা চাষ করে থাকেন। এই করোনা মহামারীর সময়েও মানুষ যখন কাজ পাচ্ছিল না, তখন জমিতে চাষাবাদ করে মাসে দশ হাজার টাকার বেশি আয় করে তিনি। এখন সমাজে পরিবার ভাল অবস্থান রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ভিশনের সহায়তা এবং পরামর্শ না পেলে জীবনে কখন এমন ইতিবাচক পরিবর্তন কখনো
সম্ভব হতো না। তার পরিবার ওয়ার্ল্ড ভিশনের কাছে চির কৃতজ্ঞ বলে কান্না ভরা কণ্ঠে এসব কথা জানান আনোয়ারা বেগম। এ ব্যাপারে বীরগঞ্জ এপি ম্যানেজার মানুয়েল হাসদা বলেন, আনোয়ারা
বেগমের মতো আরও অনেক পরিবারেগুলোতে শিশু উন্নয়নের সফলতার গল্প তৈরী হচ্ছে। এতে আমরা অনেক খুশি। এভাবেই ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ এলাকার হতদরিদ্র পরিবারের শিক্ষা, শিশু অধিকার, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রাম উন্নয়ন কমিটি, শিশু ও যুব ফোরাম, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দসহ সরকারের ঐকান্তিক সহযোগিতায় নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা আশা করি যে সকল শিশুদের স্বপ্ন বির্নিমান ও মানসম্মত জীবন গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে।