১৯৭১সাল ২৫শে মার্চ দ্বিপ্রহর রাত্রি। পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কে গ্রেফতার করার পর
তারা বাংলার ঘুমন্ত মানুষের উপর ঝাপিয়ে পরে।
শুরু হয় নারকীয় হত্যা যজ্ঞ। পাখির মতো গুলি করে হত্যা শুরু করে-
এদেশের ছাত্র, বৃদ্ধ-নারী, বয়স্ক-নারী, এমনকি শিশু কাউকে তারা রেহাই দিচ্ছে না।
শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর বাঙ্গালীর হৃদয় জয়
করা ভাষণ। তােমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পর,
“
এবারের
সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
বাঙ্গালীর অন্তর স্বাধীনতার জন্য ছটফট করতে থাকে।
বাংলার মুক্তিকামী নিরস্ত্র বাঙ্গালীর অনেকেই, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে।
অপরদিকে রাজাকার আলবদর বাহিনি
ব্যপক ভাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনিকে সহযােগিতা শুরু করে। কোন্
পরিবারের মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথা বলছে কোন্ পরিবারের সন্তান
মুক্তিযুদ্ধে নাম দিয়েছে।
তাদের লিস্ট পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পে জমা দিয়েছে।
তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার পীরগঞ্জ থানা-
বর্তমানে ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার ভেলাতৈড়, ছায়া ঘেরা পাখিডাকা
মনােরম একটি গ্রাম।
এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছােট একটি নদী। নাম তার লাচ্ছি।
যুদ্ধের ভয়াবতা, রাত হলে শুরু হয়। পাকিস্তানী সেনাদের গােলাগুলি আর মানুষের
আর্তনাদ!
হানাদার বাহিনি পীরগঞ্জে প্রবেশ করেই, রাজাকারদের সহযােগিতায় গ্রেফতার
করে ডাঃ সুজাউদ্দীন আহম্মেদ, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুর জব্বার ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ
প্রফেসর মােস্তফা সহ বেশ কয়েকজন কে । গ্রেফতারের পর তাদেরকে পীরগঞ্জ ঠাকুরগাঁও এর
মাঝামাঝি, ভাতার মারী ফার্মে নিয়ে নির্মম ভাবে বেয়নট খুচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে ।
পীরগঞ্জ কলেজে ( বর্তমান সরকারি) পাকিস্তানী হানাদার বাহিনি সেনা
ক্যাম্প করেছে।
সেখানে থাকেন ক্যাপ্টেন জাহিদ।
রাজাকার দের সহযােগীতায় ধরে আনা হয় সুন্দরি মেয়েদের,
জাহিদের যৌন লালসা মিটানাের জন্য।
ভেলাতৈড় গ্রামের একিবউদ্দীন (একি) ও টিহাকু।
খুব ভােরে দুই জোড়া গরু ও দুইটি হাল ঘাড়ে করে ভাকুড়া বিলে, একির বাপের
পৈত্তিক জমিতে হাল চাষের জন্য ছুটেছে।
টিহাকুকে কামলা হিসাবে নেওয়া হয়েছে।
আষাঢ়-শ্রাবণ মাস প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। চারিদিকে বৃষ্টির পানি ঝলমল করছে।
টিহাকু বলছে একি ভাই? সকাল হতে হতেই হাল ছাড়তে হবে।
নইলে বিপদ আসতে পারে। কারণ তারা যেখানে হাল চাষ করবে
তার কোয়ার্টার মাইল দুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তৎকালীন পীরগঞ্জঞ্ কলেজে সেনা ক্যাম্প গড়েছে।
পঞ্চগড় থেকে একটি রেল লাইন অজগর সাপের মতো একে বেকে পীরগন্জের উপর দিয়ে ঢাকায় চলে গেছে।
রেললাইনের ধারেই ভাকুড়া বিল। লাইনের পশ্চিম পার্শ্বেই,তারা হাল চাষ শুরু করেছে।
ঘন্টা দুয়েক হাল চাষ হওয়ার পর,চারিদিকে ফট ফট হওয়া শুরু হয়েছে।
টিহাকু বলেন, একি ভাই হাল বন্ধ করি।
দেখেন,যারা হাল নিয়ে এসেছে।
সবাই হাল চাষ শেষ করে বাড়ি ফিরেছে। গোটা বিলের মধ্যে আমরা শুধু দু’জন।
কথা শেষ করতে না করতেই,
উত্তর দিক থেকে শাঁই শাঁই করে একটি ট্রেন পীরগন্জ অভিমুখে চলে আসছে।
একি ভাই দেখেন?
ট্রেন আসছে, না জানি পাকিস্তানি আর্মি আছে।
পালাই!
বলার সাথে সাথে চাষা জমির উপর দিয়ে,বিলের পশ্চিম দিকে ছোপ ছোপ পানির উপর দৌড় শুরু করে তারা।
লাইনের পাশে একটি সাহারা গাছ ছিল।
আধ মিনিটের মধ্যে ট্রেনটি সেখানে এসে দাঁড়াল।
বগি থেকে দুজন বিহারী নেমেই চিৎকার করে বলতে লাগলাে।
“ওই বাঙ্গালী এধার আও,ওই বাঙ্গালী এধার আও”।
একিব উদ্দীন ও টিহাকু থরথর করে কাঁপছে। ক্ষানিক ক্ষণ পরেই হয়ত তাদের
জীবন শেষ হয়ে যাবে।
আল্লাহকে ডাকছে, চোখের মধ্যে ভেসে উঠছে তাদের পরিবার, স্ত্রী ও সন্তানদের
মুখ। আসার সময় একিবউদ্দীনের স্ত্রী বলেছিল।
ওই খানে তুমি জমি চাষের জন্য যাইওনা। দরকার নেই।
পাশেই পাকিস্তানী ক্যাম্প। ততক্ষনে তারা ট্রেনের কাছে এসে পৌছে ।
জনমের জন্য বাড়ির রাস্তাটির দিকে তাকায়। কোথাও কেউ নেই।
ট্রেনের বগি থেকে দশ বারাে জনকে বাধানাে অবস্থায় নামানাে হলাে।
ৰাধানাে লােক গুলাের মধ্যে ছিল । একজন পচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সের সুন্দরি
নারী।
তার কোলে ছিল একটি ৫-৭ মাসের ফুটফটে ছেলে শিশু।
শিশুটি চিৎকার করছে। কেঁদে কেঁদে মহিলাটির চোখ লাল হয়ে গেছে,
চোখে তার পানি নেই!
নারীর চুলগুলাে এলাে মেলাে ।
শাড়ীটি বুক থেকে সরে মাটির উপর ঝুলে আছে।
তার হাতের সাথে তার স্বামীকে বাধা হয়েছে।
এক এক করে সবাইকে নামানাে হলাে। তার পর অস্ত্র হাতে নামলাে পাঁচ জন
পাকিস্থানী হানাদার, চোখে মুখে যৌন তৃপ্তির উল্লাস!
হয়ত ট্রেনের উপরে কয়েক দফা যৌন উন্মাদনায় মেতে উঠেছিল তারা।
বুঝা যাচ্ছে মহিলাটিকে তারা ধর্ষণ করেছে। মেয়েটির মাথায় এক জন হাত বুলিয়ে
দিয়ে বলছে, “বহুত আচ্চা মাল হায়, বহুত আচ্চা হায়।”
রাজাকারের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলাে । সােজা পূর্ব দিকে যাও,
এই আইল পথ দিয়ে। ওই খান থেকে কোয়াটার মাইল দুরে । পাকিস্তানী সেনা
ক্যাম্প।
শিশুটির কান্না কোন মতে থামছেনা।
একজন হানাদার মহিলাটির হাত থেকে বাচ্চাটিকে ছিনিয়ে নিয়ে রেল লাইলের
উপর সজোড়ে আঘাত করে!
ছিটকে গেল বাচ্চাটির মগজ।
চিৎকার করে উঠলাে শিশুটির মা!
ওর বাবার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে অশ্রু ঝরছে।
নিরুপায়ও অসহায়ের মতাে সবার চোখ পানিতে টলমল করছে।
সবাই নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
পাকিস্তানী নরপিচাশ বাচ্চাটির মাথাহীন দেহ!
লাইনের ধারে প্রবাহিত পানির উপর ছুড়ে ফেলে ।
মিনিট আটেক পরেই তারা ক্যাম্পের সামনে এসে পৌছে ।
এক এক করে সবাইকে ক্যাম্পের গেটে ঢুকানাে হলাে। সবার পিছনে ছিল
একিবউদ্দীন ও টিহাকু।
তাদের সাড়া শরীর কাঁদা ও পানিতে ভেজা।
এমন সময় সিগারেট হাতে ক্যাপ্টেন জাহিদ গেটের সামনে পৌছলে,
পাকিস্তানী আর্মিদের উদ্দেশ্যে বলে “এ দো আদমিকো ছাড় দো, এ দো আদমি
কিউ,দেশ আবাদ করতা হায়।
একিবউদ্দীন ও টিহাকুকে গেটের বাইরে বের করে দিয়ে,গেট বন্ধ করে দেওয়া
হয়। দুজন পিছনে না তাকিয়ে।
আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে, বাড়ির দিকে দৌড়াতে থাকে।
আর বারবার মনে ভাবতে থাকে “এ দো আদমিকো দেশ আবাদ করতা হায়”
দৌড়াতে দৌড়াতে লাচ্ছি নদীর ধারে টিহাকু পড়ে যায়।
জোরে জোরে দম নিতে থাকে। সে বলে আমরা দেশ আবাদ করি।
শালা পাকিস্তানিরা লুট করে নিয়ে যায় । আমাদের কষ্টের সম্পদ তারা ভােগ করে।
এই ভাবে মরার চেয়ে! একি ভাই যুদ্ধে যাই। মুক্তিযুদ্ধে নাম দিই। সেই দিন সন্ধার পর শুরু হয় গুলির শব্দ। স্থানীয় এক রাজাকারের মাধ্যমে
একিবউদ্দীন জানতে পারে
মহিলাটিকে ছাড়া, সবাইকে সেদিন গুলি করে হত্যা করা হয়।
লেখক
মাসুদুর রহমান মাসুদ
কবি ও শিক্ষক
পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও।